[ADINSERTER AMP] [ADINSERTER AMP]

নেতৃত্ব সম্পর্কে বিভিন্ন মতবাদ বা ধারণা

আজকের আলোচনার বিযয় নেতৃত্ব সম্পর্কে বিভিন্ন মতবাদ বা ধারণা – যা নেতৃত্ব এর অর্ন্তভুক্ত, নেতৃত্ব এমন একটি শক্তিশালী উপায় বা ব্যবস্থা যা অধস্তন লোকদের চিন্তা-চেতনা ও প্রচেষ্টাকে লক্ষ্যার্জনে উজ্জীবিত ও পরিচালিত করে। তাই নেতৃত্বের ধরন কেমন হওয়া উচিত তা নিয়ে ব্যাপক গবেষণা ও চিন্তা- ভাবনার অন্ত নেই ।

নেতৃত্ব সম্পর্কে বিভিন্ন মতবাদ বা ধারণা

 

নেতৃত্ব সম্পর্কে বিভিন্ন মতবাদ বা ধারণা
নেতৃত্ব সম্পর্কে বিভিন্ন মতবাদ বা ধারণা

প্রতিষ্ঠানের ধরন ও এতে নিয়োজিত জনশক্তির মান এবং তাদের চিন্তা-চেতনার মধ্যে পার্থক্য থাকায় কোনো বিশেষ ধরনের নেতৃত্ব সর্বাবস্থায় ভালো ফল দেবে তাও প্রত্যাশা করা যায় না। যে কারণে গবেষকগণ এ বিষয়ে গবেষণা করতে গিয়ে বিভিন্ন বিষয়ের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন । নেতৃত্ব সম্পর্কে যে সকল প্রধান মতবাদ বা তত্ত্ব সমাজে প্রচলিত রয়েছে তা নিম্নে তুলে ধরা হলো :

১. নেতৃত্বের গুণভিত্তিক তত্ত্ব বা মতবাদ;

২. পরিস্থিতিভিত্তিক নেতৃত্ব তত্ত্ব বা মতবাদ;

৩. নেতৃত্বের উদ্দেশ্যমুখী তত্ত্ব বা মতবাদ ও

৪. নেতৃত্বের আচরণভিত্তিক তত্ত্ব বা মতবাদ ।

১. নেতৃত্বের গুণভিত্তিক তত্ত্ব বা মতবাদ (The Trait Approach of Leadership) :

“নেতা গড়ে ওঠে না; নেতা জন্মলাভ করে”- এ ধারণার ওপর এ তত্ত্ব বা মতবাদ প্রতিষ্ঠিত । এরূপ তত্ত্বকে “Greatman Theory”-ও বলা হয়। এ তত্ত্বের মূলকথা হলো যার মধ্যে কতিপয় বিশেষ গুণ বা বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান থাকে সেই প্রকৃত অর্থে নেতা হওয়ার যোগ্য।

এ সকল গুণের মধ্যে সাধুতা, ঐকান্তিকতা, নিষ্ঠা, বুদ্ধিমত্তা, সাহসিকতা ও উদ্যম, উচ্চাশা, বন্ধুপরায়ণতা, স্নেহশীলতা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য । সি. আই. বার্নার্ড, অর্ডোয়ে টিড্ প্রমুখ প্রখ্যাত লেখকগণ এরূপ মতবাদের সমর্থক। সভ্যতার শুরু হতে ১৯৫০ সাল অবধি এ ধারণা বলতে গেলে এককভাবে প্রচলিত ছিল । সি. আই. বার্নার্ড (C. I. Barnard) নেতৃত্বের গুণাবলিকে দু’ভাগে ভাগ করেছেন;

(১) অধঃস্তনদের প্রশংসা অর্জনের জন্য ভালো স্বাস্থ্য, দক্ষতা, প্রযুক্তিজ্ঞান, চিন্তাশক্তি, স্মৃতি ও উত্তম বোধগম্যতা এবং (২) অনুসারীদের তুলনায় সাহস, সহিষ্ণুতা, দৃঢ়তা ও নিরবচ্ছিন্ন প্রচেষ্টা ।  সাধারণভাবে এ মতবাদ সমাদৃত হলেও বিভিন্ন মনীষী এর সমালোচনা করেছেন । তাদের মতামত হলো-

(১) প্রকৃতপক্ষে নেতৃত্বের কোনো সর্বজনীন গুণ বা বৈশিষ্ট্য নেই;

(২) অনুসারীদের অনেকের মধ্যে নেতার অনেক গুণ থাকলেও তারা নেতা হতে পারে না;

(৩) গুণ বা বৈশিষ্ট্যের একটি সীমাবদ্ধতা রয়েছে । তাই এর পরিমাণ নির্দিষ্ট করাও অসম্ভব;

(৪) এ তত্ত্বে নেতৃত্বের গুণাবলির তুলনামূলক গুরুত্ব সম্বন্ধে কোনো আলোকপাত করা হয়নি এবং

(৫) এ মতবাদে শুধু নেতার গুণাবলির ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে, পরিবেশ পরিস্থিতির ওপর বিভিন্নভাবে সমালোচিত হলেও নেতৃত্বের ক্ষেত্রে নেতার ব্যক্তিগত গুণ ও বৈশিষ্ট্যকে কেউই অস্বীকার কোনোই গুরুত্বারোপ করা হয়নি ।

M. Stogdill Ghiselli, Keith Devis প্রমুখ মনীষীগণ তাদের গবেষণার দ্বারা প্রমাণ করেছেন যে, নেতা সৃষ্টিতে ব্যক্তিগত গুণ বা বৈশিষ্ট্য উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। পরিবেশ-পরিস্থিতি যাই হোক না কেন বা প্রশিক্ষণের সুযোগ যে মানেরই থাকুক না কেন ব্যক্তিগত গুণ-বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে তা সমন্বিত হলেই মাত্র যোগ্য নেতৃত্ব সৃষ্টি হতে পারে ।

২. পরিস্থিতিভিত্তিক নেতৃত্ব তত্ত্ব বা মতবাদ (Situation Approachof Leadership) :

“Leaders are the product of given situation”-অর্থাৎ কোনো বিশেষ পরিস্থিতিতেই নেতার আবির্ভাব ঘটে -এ ধারণার ওপর এরূপ নেতৃত্বের মতবাদ প্রতিষ্ঠিত । এক্ষেত্রে মনে করা হয় যে, নেতা সৃষ্টিতে ব্যক্তির ব্যক্তিগত গুণাবলির সঙ্গে তার পরিবেশ-পরিস্থিতির গুরুত্বপূর্ণ যোগসূত্র রয়েছে। একজন বিশেষ গুণাবলিসম্পন্ন ব্যক্তি তখনই সত্যিকার নেতা হবেন যখন তিনি পারিপার্শ্বিক পরিবেশ-পরিস্থিতি মোকাবিলায় উক্ত গুণাবলির সাফল্যজনক ব্যবহার করতে পারবেন । এ তত্ত্বের মূল দর্শন হলো- নেতা যে বিশেষ পরিবেশ-পরিস্থিতিতে কাজ করেন সেই পরিবেশই নেতৃত্বকে সর্বাধিক প্রভাবিত করে ।

 

google news
আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

E. Fiedler-এর মতে, “তিনটি চলক বা বিষয়ের ওপর নেতৃত্ব নির্ভর করে; ক) নেতা-সদস্য সম্পর্ক (The leader-member relationship); (খ) কার্য কাঠামো (Task structure) ও (গ) নেতার পদমর্যাদাগত সম্পর্ক (Positional relationship of leader)। 14 তিনি মনে করেন নেতা-সদস্য সম্পর্ক ভালো হলে, কার্য কাঠামো গোছালো হলে এবং নেতার পদমর্যাদাগত ক্ষমতা শক্তিশালী হলে নেতৃত্ব বলিষ্ঠ ও কার্যকরী হয় । অন্যথায় নেতৃত্ব দুর্বল হয়ে থাকে। তাই এ সকল পরিবেশ নেতৃত্ব সৃষ্টিতে অতীব গুরুত্বপূর্ণ । পরিস্থিতিভিত্তিক নেতৃত্ব তত্ত্বও বিভিন্নভাবে সমালোচিত হয়েছে। এরূপ সমালোচনার মূল প্রতিপাদ্য বিষয়

(১) এরূপ নেতৃত্বের গুণাবলি বা বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে কোনো আলোকপাত করা হয়নি অথচ সকল নেতার মধ্যেই কতকগুলো সর্বজনীন গুণ বা বৈশিষ্ট্য থাকতে হয় এবং 

(২) পরিবেশ-পরিস্থিতি অনুকূল হলেই নিয়োজিত নেতা সফল নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে কিন্তু তার নিযুক্তির বিষয়টি গুণ ও বৈশিষ্ট্যের ওপর নির্ভরশীল ।

Koontz & O. Donnell এরূপ তত্ত্বের সমালোচনা করতে গিয়ে বলেছেন, “Situationalists have overlooked the possibility that some traits influence their possessors to attain leadership success and some others increase the chances of their becoming leaders. “15 অর্থাৎ কতিপয় গুণাবলি তার অধিকারীকে সফল নেতৃত্ব লাভের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয় এবং আরো কিছু গুণাবলি তাদের নেতা হওয়ার সুযোগ বাড়ায়- এ বিষয়টিকে পরিস্থিতিবাদীরা উপেক্ষা করেছেন ।

নানানভাবে সমালোচিত হলেও ব্যবহারিক দৃষ্টিকোণ বিবেচনায় এ তত্ত্বটি অধিক গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হয়ে আসছে । কারণ একই অবস্থানে কর্মরত লোকদের মধ্যে কম-বেশি কতকগুলো সার্বজনীন গুণ বর্তমান থাকে। এরূপ গুণসম্বলিত লোকদের মধ্যে যারা অধস্তনদের অবস্থা, কার্য পরিবেশ ইত্যাদি বিষয় বিবেচনা করে সবার সঙ্গে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা ও পরিবেশকে নিয়ন্ত্রণে রেখে কাজ করতে পারে তার পক্ষেই নেতার আসন অলংকৃত করা সহজ ।

৩. নেতৃত্বের উদ্দেশ্যমুখী তত্ত্ব বা মতবাদ(Path-goal Approach of Leadership) :

নেতৃত্বের উদ্দেশ্যমুখী তত্ত্ব পরিস্থিতিভিত্তিক নেতৃত্ব তত্ত্বের সঙ্গে অনেকটা সামঞ্জস্যপূর্ণ। এক্ষেত্রে নেতৃত্ব কীভাবে প্রাতিষ্ঠানিক উদ্দেশ্য অর্জনে পরিবেশকে কাজে লাগাতে পারে তার ব্যবহারিক দিক সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে । Robert House ও তার অনুসারীরা এরূপ তত্ত্বের উদ্যোক্তা ।

Robert House এরূপ তত্ত্বের ওপর আলোকপাত করতে গিয়ে বলেন, “The leaders job is to create work environment through structure support and rewards that helps employees reach the organisations goals.” 16 অর্থাৎ নেতার কাজ হলো কাঠামোগত সহায়তা দান ও পারিশ্রমিক প্রদানের মাধ্যমে কার্য পরিবেশ সৃষ্টি করা যা কর্মীদের সাংগঠনিক উদ্দেশ্য অর্জনে সহায়তা করে ।

এরূপ তত্ত্বের দু’টি প্রধান দিক লক্ষণীয়; (১) উদ্দেশ্য অভিমুখিতা সৃষ্টি করা ও (২) উদ্দেশ্যের দিকে পথের উন্নয়ন করা । এক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক উদ্দেশ্যের আলোকে ব্যক্তিক উদ্দেশ্য নির্ধারণে উৎসাহিত করা হয় । কর্মীদের প্রয়োজন শনাক্ত করে প্রয়োজনীয় পারিশ্রমিক ও পুরস্কারের ব্যবস্থা করা হয় এবং কার্যক্ষেত্রে সৃষ্ট বিভিন্নমুখী বাধা দূর করে সঠিকভাবে নির্দেশনা প্রদান করা হয় । ফলে কর্মীরা নেতাকে আপন করে গ্রহণ করে ও কার্যক্ষেত্রে উচ্চ সন্তুষ্টি বজায় থাকে ।

এরূপ তত্ত্ব অনুযায়ী যে ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্যে বুঝে সে অনুযায়ী অধস্তনদেরকে সঠিকভাবে উদ্বুদ্ধ করে কাজ আদায় করতে পারে সেই প্রকৃত নেতা হিসেবে গণ্য হয় । যেকোন প্রতিষ্ঠানেই এরূপ নেতৃত্ব অধিক সফলতা অর্জন করতে পারে ।

 

নেতৃত্ব সম্পর্কে বিভিন্ন মতবাদ বা ধারণা
নেতৃত্ব সম্পর্কে বিভিন্ন মতবাদ বা ধারণা

 

৪. নেতৃত্বের আচরণভিত্তিক তত্ত্ব বা মতবাদ (Behavioural Approach of Leadership) :

এ তত্ত্বে মনে করা হয় নেতৃত্ব নির্ভর করে কোনো বিষয়ের প্রতি নেতার মনোভাব বা আচরণের ওপর। কোনো একটি দলের সংঘবদ্ধ আচরণের সঙ্গে নেতার আচরণ সংগতিপূর্ণ হলেই তার পক্ষে সেখানে নেতৃত্ব দেয়া সম্ভব । কোনো ভালো মানুষের দলে খারাপ লোকের নেতৃত্ব যেমনি কার্যকর হয় না তেমনি ডাকাত দলের নেতৃত্ব প্রদানও ভালো লোকের পক্ষে সম্ভব নয় ।

অধস্তন জনশক্তি যদি শিক্ষিত ও গণতন্ত্রমনা হয় তবে সেখানে স্বৈরাচারী নেতৃত্ব কার্যকর হতে পারে না । সেখানে গণতান্ত্রিক নেতৃত্বই কার্যকরী হয় । একইভাবে যেখানে অধস্তনরা সেকেলে মানসিকতার অধিকারী এবং অদক্ষ ও অশিক্ষিত সেখানকার নেতৃত্ব স্বৈরাচারী বা বড়জোর পিতৃসুলভ হতে পারে ।

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment