ব্যবস্থাপনায় কৌশল বা স্ট্র্যাটিজি বা স্ট্র্যাটীজিক পরিকল্পনার প্রকারভেদ নিয়ে আজকের আলোচনা। এই পাঠটি “ব্যবস্থাপনা নীতিমালা” বিষয়ের ” পরিকল্পনা” বিষয়ক পাঠের অংশ। স্ট্র্যাটিজি বা স্ট্র্যাটীজিক পরিকল্পনা হলো পরিপার্শ্বিকতার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য অর্জনের এক বড়ো ধরনের কর্মসূচি বা পরিকল্পনা । স্ট্র্যাটিজি এক ধরনের পরিকল্পনা হিসেবে গণ্য হলেও সাধারণ পরিকল্পনা হতে তা ভিন্ন হয়ে থাকে। এক বছরে বা এক মাসে উৎপাদন বিভাগে কতটা পণ্য উৎপাদন করা হবে তাকে উৎপাদন বিভাগের পরিকল্পনা বলা হয় ।
কোনো পণ্য নির্দিষ্ট বাজারে কতটা বিক্রয় করা হবে এটা নির্ধারণ করা হলে তাকে বিক্রয় পরিকল্পনা বলে। কিন্তু বাজারে নিজস্ব ইমেজ বৃদ্ধির সাথে সাথে বিক্রয় বৃদ্ধির জন্য পণ্যমান বৃদ্ধি, পণ্যব্যয় হ্রাস, পণ্যমূল্য হ্রাস, বাড়তি বাজারজাতকরণ প্রসার কার্যক্রম গ্রহণ এ গুলোর মধ্যে কোন কৌশল গ্রহণ করা হবে তা নির্ধারণকে স্ট্র্যাটিজি বলে।
Table of Contents
ব্যবস্থাপনায় কৌশল বা স্ট্র্যাটিজি বা স্ট্র্যাটীজিক পরিকল্পনার প্রকারভেদ
ইমেজ বৃদ্ধি করা প্রয়োজন না বর্তমান ইমেজ ধরে রাখা দরকার অথবা বর্তমান ব্যবসায় হতে ধীরে ধীরে সরে এসে নতুন ব্যবসায়ে নতুন করে ইমেজ সৃষ্টিতে মনোযোগ দেয়া আবশ্যক এটাও স্ট্র্যাটিজি হিসেবেই গণ্য । তাই স্ট্র্যাটিজি পরিকল্পনার দিক দর্শন (Guide line) স্বরূপ ।
একসময়ে ব্যবসায় ছিল ক্ষুদ্র প্রকৃতির। তাই পরিকল্পনার ধরনও ছিল স্বল্পমেয়াদি ও সাদামাটা ধরনের । তাই পরিকল্পনা বলতে তখন কার্যসম্বন্ধীয় পরিকল্পনাকে (Operational plan) বুঝানো হতো। তাই সে সময়ে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কৌশলকেই মূলত স্ট্র্যাটিজি হিসেবে দেখা হতো।
কিন্তু বর্তমানে বৃহদায়তন প্রতিষ্ঠানগুলোতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, কৌশলগত পরিকল্পনা এবং তার আলোকে কার্যসম্বন্ধীয় পরিকল্পনা গৃহীত হয় । তেমনি বিভিন্ন ধরনের পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের দিকনির্দেশনা হিসেবে বিভিন্ন ধরনের স্ট্র্যাটিজিও নির্দিষ্ট করা হয়ে থাকে।
বর্তমানকালে বৃহদায়তন প্রতিষ্ঠানসমূহে যে সকল স্ট্র্যাটিজি বা স্ট্র্যাটাজিক পরিকল্পনা ব্যবহৃত হয় বিভিন্ন ব্যবস্থাপনা বিশারদ তাকে বিভিন্নভাবে তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছেন। Pearce ও Robinson সাংগঠনিক স্তর বিবেচনায় স্ট্র্যাটিজিকে তিনটি প্রধান ভাগে ভাগ করে নিম্নের রেখাচিত্রের সাহায্যে তা তুলে ধরেছেন :
উপরে উল্লিখিত স্ট্র্যাটিজির প্রকারভেদ নিম্নে আলোচনা করা হলো :
১. সংস্থা বা কর্পোরেট পর্যায়ের স্ট্যাটিজি (Corporate level strategy) :
সংস্থা বলতে একাধিক প্রতিষ্ঠানের সম্মিলিত সংগঠনকে বুঝায়। হোল্ডিং কোম্পানিকে এরূপ সংস্থা হিসেবে গণ্য করা হতে পারে । কারণ এরূপ কোম্পানি মূলত সাবসিডিয়ারি কোম্পানিসমূহের পরিচালনা নিয়ন্ত্রণ করে। বিভিন্ন গ্রুপ ইন্ডাস্ট্রিজও এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
বাংলাদেশে বেক্সিমকো গ্রুপ, নিটল গ্রুপ ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানকে একটি সংস্থা হিসেবে গণ্য করা যায়। সরকারি প্রতিষ্ঠান বি.সি.আই.সি, বি.টি.এম.সি. ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানকে কর্পোরেশন বা সংস্থা নামেই আখ্যায়িত করা হয় । সংস্থা পরিচালনার জন্য উচ্চ পর্যায়ের নির্বাহীগণ দায়িত্ব পালন করেন । সংস্থার পক্ষ থেকে অধস্তন ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালনার জন্য দীর্ঘমেয়াদি যে স্ট্র্যাটিজি নির্ধারণ করা হয় তাকে সংস্থা পর্যায়ের স্ট্র্যাটিজি বলে ।
Griffin-এর মতে, “Corporate level startegy is the set of strategic alternatives that an organization chooses from as it manages its operation simultaneously across several industries and several markets. অর্থাৎ শিল্প বা বাজারের কার্যক্রম একই সঙ্গে পরিচালনার স্বার্থে অনেকগুলো দাঁড় করানো স্ট্র্যাটিজি থেকে বাছাইকৃত স্ট্র্যাটিজিসমূহকে সংস্থা পর্যায়ের স্ট্র্যাটিজি বলে ।
Bartol ও Martin-এর মতে, “Corporate level strategy addresses what business the organization will operate, how the strategies of those business will be co-ordinated to strengthen the organization competitive position and how resources will be allocated among the business. “
অর্থাৎ সংস্থাভিত্তিক স্ট্র্যাটিজির আওতাধীন বিষয় হলো- প্রতিষ্ঠান কোন্ কোন্ ধরনের ব্যবসায় সংগঠন প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করবে, কীভাবে ঐ সকল ব্যবসায়ের স্ট্র্যাটিজিগুলো সমন্বিত হয়ে প্রতিষ্ঠানের প্রতিযোগিতার সামর্থ্যকে শক্তিশালী করবে এবং কীভাবে সম্পদরাজিকে অধীনস্ত ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে বন্টন করা হবে। Bartol ও Martin সংস্থাভিত্তিক স্ট্র্যাটিজিকে একটি রেখাচিত্রের সাহায্যে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করে প্রদর্শন করেছেন । হুবহু তা নিয়ে তুলে ধরা হলো :
সংস্থার কেন্দ্রীয় পর্যায়ের মূল স্ট্র্যাটাজিক নির্দেশনা যোগায় এমন স্ট্র্যাটিজিই হলো প্রধান বা মূল স্ট্র্যাটিজি । একে ক্ষেত্রবিশেষে মহৎ (Master) স্ট্র্যাটিজিও বলে । সংস্থাভিত্তিক স্ট্র্যাটিজিকেই প্রধান বা মূল স্ট্র্যাটিজি নামে আখ্যায়িত করা হয় । নিম্নে এরূপ স্ট্র্যাটিজির বিভিন্ন শ্রেণীর ভাগ আলোচিত হলো :
প্রতিরক্ষামূলক স্ট্র্যাটিজি (Defensive strategy) :
বর্তমান বৃহদায়তন প্রতিযোগিতাপূর্ণ বিশ্বে কোনো ব্যবসায়কে টিকে থাকতে হলে প্রতিরক্ষামূলক বিভিন্ন স্ট্র্যাটিজির অনুসরণ করতে হয় । টিকে থাকা বলতে মুনাফা অর্জনের সামর্থ্যকে দীর্ঘমেয়াদে ধরে রাখাকে বুঝায়। এরূপ সামর্থ্য বজায় রাখার স্বার্থে প্রতিষ্ঠানের ব্যয়কে সবসময় কাঙ্ক্ষিত অবস্থার মধ্যে ধরে রাখার এবং বাড়তি ব্যয় ও ঝামেলা যথাসম্ভব কমানোর প্রয়োজন পড়ে।
কখনই প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত কোনো কর্মী, নির্বাহী, উপবিভাগ, বিভাগ বা সংস্থার অঙ্গীভূত কোনো প্রতিষ্ঠান যাতে সংস্থার জন্য অপ্রয়োজনীয় বা বোঝা হয়ে দাঁড়াতে না পারে এজন্য প্রতিরক্ষামূলক স্ট্র্যাটিজির অনুসরণ করে।
Pearce & Robinson এরূপ স্ট্র্যাটিজি সম্পর্কে বলেন, “Defensive strategies focus on the desire or need to reduce organizational operations, usually through cost reductions and/or asset reductions.” অর্থাৎ খরচ কমানোর মাধ্যমে বা সম্পত্তি বিক্রয়পূর্বক তা হ্রাসের মাধ্যমে সাংগঠনিক কার্যক্রমকে গুটিয়ে ফেলার জন্য যে স্ট্র্যাটিজির আশ্রয় গ্রহণ করা হয় তাকে প্রতিরক্ষামূলক স্ট্র্যাটিজি বলে । এরূপ স্ট্র্যাটিজির আওতাধীন বিভিন্ন স্ট্র্যাটিজিসমূহ নিম্নে আলোচনা করা হলো :
i) ফসল সংগ্রহের স্ট্র্যাটিজি (Harvest strategy) :
যেক্ষেত্রে সংস্থার সঙ্গে সম্পর্কিত ব্যবসায়গুলোর ভবিষ্যৎ খুব সুবিধাজনক বলে মনে করা হয় না সেক্ষেত্রে ঐ ব্যবসায়গুলোতে আর দীর্ঘমেয়াদি কোনো বিনিয়োগ না করে স্বল্পমেয়াদি বিনিয়োগের কৌশল অবলম্বন করা হয় । এতে নগদ অর্থের প্রবাহ যেমনি ধরে রাখা যায় তেমনি স্বল্পমেয়াদি বিনিয়োগের মাধ্যমে মুনাফা অর্জনের সর্বোচ্চ সুযোগ কাজে লাগানোর প্রয়াস নেয়া হয় ।
এ ধরনের স্ট্র্যাটিজিকেই ফসল সংগ্রহের স্ট্র্যাটিজি বলে । এর বড় সুবিধা হলো নগদ অর্থ বা তরল সম্পদ এতে হাতে জমা হয় এবং ঝুঁকির পরিমাণ হ্রাস পায়। ফলে ভবিষ্যতে দেখেশুনে সংস্থা লাভজনক ও সম্ভাবনাময় ব্যবসায়ে অর্থ বিনিয়োগ করতে হয় ।
ii) ঘুরে দাঁড়ানোর স্ট্র্যাটিজি (Turnaround strategy) :
যখন বাজারে মন্দা বা প্রতিকূল অবস্থা চলতে থাকে তখন তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার এবং সুযোগ আসলে বা প্রতিকূলতা কাটলে দ্রুত ঘুরে দাঁড়ানোর বা সকল শক্তি নিয়ে সামনে অগ্রসর হওয়ার কৌশলকে ঘুরে দাঁড়ানোর স্ট্র্যাটিজি বলে।
ব্যবসায়-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বাণিজ্য চক্র বা মন্দা অনেক সময় এমনভাবে এসে দাঁড়ায় যখন আক্রমণাত্মক কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা অনর্থক বিবেচিত হয় । তাই পূর্ব হতে অবস্থা বিবেচনা করে সংস্থার পক্ষ থেকে প্রতিকূলতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব ধরে রাখা এবং শক্তি সঞ্চয়ের কৌশল অবলম্বন করা হয় ।
এরপর যখন সম্ভাবনার পরিবেশ সৃষ্টি হয় তখন প্রতিযোগীদের গা ঝাঁড়া দিয়ে ওঠার আগেই দ্রুত পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার নীতি অনুসরণ করা হয়। এতে সবাইকে তাক লাগিয়ে বাজারে নিজের শক্ত অবস্থান দাঁড় করানো সম্ভব হয় ।
iii) পরিত্যাগ করার স্ট্র্যাটিজি (Divestiture strategy) :
যেক্ষেত্রে সংস্থার অধীন এক বা একাধিক ব্যবসায়ের ভবিষ্যতে আর তেমন কোনো সম্ভাবনা লক্ষ্য করা যায় না তখন সেখান থেকে যতোটা দ্রুত সম্ভব পুঁজি প্রত্যাহার করে তা অন্যত্র খাটানোর নীতি অনুসরণ করা হলে তাকে পরিত্যাগ করার স্ট্র্যাটিজি বলে । একটা শিল্প প্রতিষ্ঠান রুগ্ন হিসেবে বা ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান অলাভজনক হিসেবে একবার পরিগণিত হলে তাতে নানা ধরনের উপসর্গ দেখা দেয়।
সেমতাবস্থায় যতোই দিন যায় ততোই ক্ষতির পরিমাণ বাড়তে থাকে । এক পর্যায়ে গিয়ে এরূপ প্রতিষ্ঠান আর সুবিধাজনকভাবে বিক্রয় করারও সুযোগ থাকে না। তাই একটি সংস্থা তার অধীন এরূপ প্রতিষ্ঠানগুলো ছেড়ে দেয়ার স্ট্র্যাটিজি বা রণকৌশল গ্রহণ করতে পারে । এতে অসম্ভাবনাময় খাত থেকে পুঁজি লাভজনক খাতে স্থানান্তর করতে হয় ।
iv) দেউলিয়াত্ববরণের স্ট্র্যাটিজি (Bankruptcy strategy) :
শুনতে খারাপ শোনালেও ক্ষেত্রবিশেষে এ ধরনের রণকৌশল সংস্থার জন্য লাভজনক বিবেচিত হয়। এরূপ রণকৌশল অবলম্বনের মাধ্যমে সংস্থার সামগ্রিক সুনাম ও ব্যবসায়িক সম্ভাবনা রক্ষা করা যেতে পারে । একটা প্রতিষ্ঠান যখন খুবই দৈন্য-দশার মধ্যে থাকে তখন তার পক্ষে সবার সঙ্গে কথা রক্ষা করে সুনামের সঙ্গে ব্যবসায় পরিচালনা সম্ভব হয় না। তাই সেমতাবস্থায় প্রতিষ্ঠানের ব্যাপক সুনামহানির সম্ভাবনা থাকে ।
রাখ-ঢাকের নীতি গ্রহণ করা হলে তা সংশ্লিষ্ট সবার মধ্যে নানান ধরনের সন্দেহ-সংশয় সৃষ্টি করে । তাই সেমতাবস্থায় স্বেচ্ছায় আইনের কাছে ধরা দিয়ে দেউলিয়াত্ব বরণের রণকৌশল গ্রহণ করা যায় । এতে সংস্থার পক্ষে দুর্বল ইউনিট নিয়ে বাড়তি পেরেশানির প্রয়োজন হয় না।
আদালত যদি দেখে যে উক্ত প্রতিষ্ঠানের পরিচালকদের খারাপ কোনো দুরভিসন্ধি নেই সেক্ষেত্রে দায়মুক্ত দেউলিয়া ঘোষণা করে। ফলে পরিচালকগণ আবার নতুন করে ব্যবসায় শুরু করতে পারেন এবং তাদের যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে আবার নতুনভাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারে।
v) বিলোপসাধনের স্ট্র্যাটিজি (Liquidation strategy) :
প্রতিষ্ঠানের বিলোপসাধনও প্রতিরক্ষামূলক স্ট্র্যাটিজির একটা গুরুত্বপূর্ণ কৌশল হতে পারে । যখন সংস্থার অধীন কোনো একটা প্রতিষ্ঠান চালানো দীর্ঘমেয়াদে লাভজনক বিবেচিত হয় না বা দীর্ঘমেয়াদে দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থেকে তখন সুবিধামতো সময়ে এটার বিলোপসাধন করা হলে এতে ভবিষ্যতে ঝুঁকির পরিমাণ অনেকাংশে হ্রাস পায় ।
সুবিধাজনক অবস্থানে থেকে কোনো প্রতিষ্ঠানের বিলোপসাধন করা হলে শেয়ারহোল্ডারদের বড় ধরনের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। বিলোপের কারণ যদি অন্যান্য শেয়ারহোল্ডারদের সঠিকভাবে বুঝানো যায় তবে তারাও সন্তুষ্ট থাকে । বিলোপকৃত প্রতিষ্ঠান থেকে পাওনা বুঝে পেয়ে সংস্থার অধীন অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে তারা বিনিয়োগে উৎসাহিত হয়। পাওনাদারগণও তাদের পাওনা বুঝে পেয়ে সংস্থার প্রতি সন্তুষ্ট থাকে ।
সংস্থাও তার বিনিয়োগকৃত অর্থ নিয়মমাফিক প্রাপ্ত হয়ে নতুনভাবে লাভজনক খাতে তা বিনিয়োগ করতে পারে। এতে সংস্থার সুনামহানির সম্ভাবনাও অনেকাংশে হ্রাস পায় । এ ছাড়া আইনগত ঝামেলাও এর দ্বারা এড়ানো যায় ।
খ) বিদ্যমান অবস্থা ধরে রাখার স্ট্র্যাটিজি (Stability strategy) :
বিদ্যমান অবস্থা ধরে রাখার স্ট্র্যাটিজিও ক্ষেত্র বিশেষে প্রতিষ্ঠানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হয়। যেক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধির হার বা মুনাফা অর্জন সামর্থ্য একটা কাঙ্ক্ষিত অবস্থায় এসে পৌঁছে তখন এ অবস্থা ধরে রাখার চিন্তা প্রতিষ্ঠানের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হতে পারে। এ অবস্থা বজায় রাখার রণকৌশলকে বিদ্যমান অবস্থা ধরে রাখার স্ট্র্যাটিজি বলে। এরূপ অবস্থা ধরে রখার স্বার্থেও প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়ন বা কাজের পদ্ধতিগত উন্নয়নের ধারা বজায় রাখা গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে । তবে তা সবই করা হয় বর্তমান অবস্থা ধরে রাখার স্বার্থে ।
Bartol ও Martin-এর মতে, “A stability strategy involves maintaining the status quo or growing in a methodical, but slow, manner. 102 অর্থাৎ বর্তমান স্থিতাবস্থা ধরে রাখা অথবা অনেক ধীরগতিতে হলেও পদ্ধতিগত উন্নয়নের ধারা বজায় রাখার সঙ্গে বিদ্যমান অবস্থা ধরে রাখার স্ট্র্যাটিজি সম্পর্কিত । লেখকদ্বয় পদ্ধতিগত উন্নয়নের ধারা ধীরগতিতে হলেও ধরে রাখাকে স্থিতাবস্থা বজায় রাখা প্রয়াস বলে মনে করেছেন এবং পরবর্তী সময়ে নতুন করে উন্নয়ন পদক্ষেপ বা প্রবৃদ্ধি অর্জনের স্বার্থে একে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছেন। এ ধরনের স্ট্র্যাটিজি নিম্নোক্ত উদ্দেশ্যে মূলত গ্রহণ করা হয়ে থাকে :
১.যেক্ষেত্রে কোনো ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার অধীনে প্রতিষ্ঠানগুলো যথেষ্ট ভালো বা কাম্য অবস্থায় পৌঁছে তখন প্রতিষ্ঠানের নতুন উন্নয়ন পরিকল্পনার ঝুঁকি উচ্চ নির্বাহীগণ নিতে চান না বরং বিদ্যমান অবস্থার সকল সুযোগ নেয়ার স্বার্থেই এ ধরনের স্ট্র্যাটিজির অনুসরণ করা হয় ।
২. অনেক সময় ব্যক্তি মালিকানাধীন বা অংশীদারি বা প্রাইভেট কোম্পানি যখন তাদের ব্যবস্থাপনার সামর্থ্য চিন্তায় সবচেয়ে ভালো অবস্থায় থাকে তখন মালিকানাগত পরিবর্তন এনে ঝামেলা বাড়ানোর পরিবর্তে বিদ্যমান অবস্থা বজায় রাখার কৌশল গ্রহণ করে ।
৩. একটা প্রতিষ্ঠান যখন প্রতিযোগিতার দৌড়ে ভালো অবস্থায় এসে পৌঁছে তখন মুনাফা অর্জনের সামর্থ্য (Profitability) দীর্ঘমেয়াদে ধরে রাখার স্বার্থেই উপায়-উপকরণাদির প্রয়োজনীয় সংস্কার সাধনের প্রয়োজন দেখা দেয় । এ লক্ষ্য অর্জনে এ ধরনের স্ট্র্যাটিজির অনুসরণ করা হয় ।
৪. যেক্ষেত্রে দেখা যায় ব্যবসায়ের প্রবৃদ্ধির হার ভবিষ্যতে আর উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ার কোনোই সম্ভাবনা নেই সেক্ষেত্রে বর্তমান প্রবৃদ্ধিকে ধরে রেখে পরবর্তী করণীয় চিন্তার প্রয়োজনেও এ ধরনের স্ট্র্যাটিজির আশ্রয় গ্রহণ করা হয়।
গ) প্রবৃদ্ধি দ্রুততর করার স্ট্র্যাটিজি (Growth strategy) :
স্রষ্টার এ মহান সৃষ্টির প্রতিটা স্তরেই একটা গতির উপস্থিতি লক্ষণীয় । এই গতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে না পারলে সেখানে ধ্বংস বা ক্ষতি অনিবার্য হয়ে ওঠে । ব্যবসায় জগতেও উন্নয়নের ক্রমোন্নতি সবসময়ই লক্ষণীয় । বর্তমানকালে প্রযুক্তিগত ও পদ্ধতিগত উন্নয়ন এতটাই দ্রুত ও ব্যাপক যে এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যেতে না পারলে কোনো ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের পক্ষেই ভালো করা সম্ভব নয় । স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে চাইলে উন্নয়নের ধারার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু যখন কোনো প্রতিষ্ঠান প্রতিযোগিতার দৌড়ে অন্যদের থেকে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে তখন তাকে অন্যদের তুলনায় বা প্রতিষ্ঠানের বর্তমান উন্নয়নের গতি হতে অধিক উন্নয়নের ধারায় এগিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে । এজন্য কোনো প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা যে স্ট্র্যাটিজির আশ্রয় গ্রহণ করে তাকে প্রবৃদ্ধি দ্রুততর করার স্ট্র্যাটিজি বলে ।
Bartol Martin বলেছেন, “Growth strategies are grand strategies that involve organizational expansion along some major dimension. In business organizations, growth typicaly means incoming sales and earning.”103 অর্থাৎ প্রবৃদ্ধির হার দ্রুতকরণের স্ট্র্যাটিজি হলো বড় ধরনের স্ট্র্যাটিজি যা কতকগুলো মাত্রাগত দিক বজায় রেখে সাংগঠনিক সম্প্রসারণের সঙ্গে সম্পৃক্ত। ব্যবসায় সংগঠনের বেলায় প্রবৃদ্ধি বলতে মূলত বিক্রয় ও উপার্জন বৃদ্ধিকে বুঝায় । এরূপ স্ট্র্যাটিজিকে নিম্নোক্ত প্রধান তিনটি ভাগে ভাগ করা যায় :
i) মনোযোগ কেন্দ্রীভূতকরণের স্ট্র্যাটিজি (Concentration strategy) :
যেকোনো প্রতিষ্ঠানেই দেখা যায় এর উৎপাদিত পণ্য ও সেবার মধ্য থেকে স্বল্পসংখ্যক কয়েকটি পণ্য বাজারে যথেষ্ট প্রসার বা পরিচিতি লাভ করে । বৃহদায়তন প্রতিষ্ঠানগুলো চালু পণ্যের বা সেবার বাজার ধরে রাখার স্বার্থেই অন্যান্য পণ্য বাজারে চালু রাখে । আবার চালু পণ্যকে ঘিরে বাজারে অন্যান্য পণ্যের বাজারজাতকরণ, প্রচার, সরবরাহ ইত্যাদি সুবিধা লাভ করা যায় ।
তাই প্রাধান্য বিস্তারকারী (Leading) পণ্য বা সেবার বাজার যতো বাড়ানো যায়, প্রতিষ্ঠানের অন্যান্য পণ্য বা সেবা ততোই নতুন বাজারে প্রবেশ বা নতুন ক্রেতাদের কাছে পৌছানো সহজ হয় । তাই প্রতিষ্ঠানের সম্ভাবনাময় এক বা একাধিক পণ্য বা সেবা অথবা সংস্থার অধীন একাধিক ব্যবসায়ের কোনো একটি ব্যবসায়ের প্রতি অধিক মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করে তাকে প্রতিষ্ঠানের বা সংস্থার মুখ্য বা চালিকাশক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার কৌশল অনুসরণ হলে তাকে মনোযোগ কেন্দ্রীভূতকরণের স্ট্র্যাটিজি বলে ।
ii) উলম্ব একত্রীকরণের স্ট্র্যাটিজি (Vertical integration strategy) :
বর্তমানকালে বৃহদায়তন প্রতিষ্ঠানসমূহ উলম্ব একত্রীকরণের মাধ্যমে সংস্থা বা ব্যবসায়ের মুনাফা ও প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধির স্ট্র্যাটিজি বা রণকৌশল গ্রহণ করে থাকে। এরূপ একত্রীকরণ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান খুলে বা ক্রয় করে এবং তা বর্তমান প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্তিপূর্ণভাবে সংযোগ বা একীভূতকরণের মাধ্যমে করা যেতে পারে ।
আবার কোনো উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান তার উৎপাদিত পণ্য মধ্যস্থ কোনো প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিক্রয় না করে এ ধরনের প্রতিষ্ঠান নিজে খুলে তা ব্যবসায়ের সঙ্গে একত্রীকরণ করতে পারে এবং এভাবে ব্যবসায়ের আওতা এবং সেই সঙ্গে ব্যবসায়ের সামর্থ্য ও প্রবৃদ্ধির উন্নয়ন ঘটাতে পারে । এ উভয় অবস্থাকেই উলম্ব একত্রীকরণের স্ট্র্যাটিজি বলে ।
ধরা যাক, বাটা সু কোম্পানি তাদের মানসম্মত চামড়া সংগ্রহের জন্য একটা নির্দিষ্ট ট্যানারির ওপর নির্ভর করে। এখন তারা ঐ ট্যানারিটা কিনে বা কোনোভাবে যদি নিজেদের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একত্রীকরণ করে বা ঐ ধরনের একটা ট্যানারি নিজ মালিকানায় প্রতিষ্ঠা করে তবে তাকে পশ্চাত্বর্তী একত্রীকরণ (Backward integration) বলা হয় ।
আবার কোনো জুতা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান নিজ উৎপাদিত পণ্য বিক্রয়ের জন্য ডিস্ট্রিবিউটর বা পাইকারদের ওপর নির্ভর করে। এখন যদি উক্ত কোম্পানি বিভিন্ন স্থানে নিজেই ডিস্ট্রিবিউশন সেন্টার খুলে তা ব্যবসায়ের আওতায় একত্রে পরিচালনা করে বা এরূপ প্রতিষ্ঠানকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আসে তবে তাকে সম্মুখবর্তী একত্রীকরণ (Forward integration) বলে । একটা সংস্থা সহজেই এ ধরনের একত্রীকরণের স্ট্র্যাটিজি গ্রহণ করে অন্যের ওপর নির্ভরতা ও ঝুঁকি কমিয়ে সংস্থার উন্নয়ন ঘটাতে পারে ।
iii) বৈচিত্র্যকরণের স্ট্র্যাটিজি (Diversification strategy) :
সংস্থার আওতায় নতুন ধরনের ব্যবসায় স্থাপনের মাধ্যমে অথবা ব্যবসায়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত হলেও পূর্বে উৎপাদন বা বিক্রয় করা হয়নি এমন কোনো এক বা একাধিক নতুন পণ্য উৎপাদন বা বিক্রয় করার মাধ্যমে ব্যবসায়ের প্রবৃদ্ধির মাত্রা বাড়ানোর কৌশল গ্রহণ করা হলে তাকে বৈচিত্র্যকরণের স্ট্র্যাটিজি বলে । অনেকসময় দেখা যায় কোনো সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান যে ধরনের ব্যবসায় পরিচালনা করে বা যে ধরনের পণ্য উৎপাদন বা বিক্রয় করে তার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের বড়ো ধরনের কোনো অগ্রগতি অর্জনের তেমন কোনো সম্ভাবনা থাকে না । ফলে প্রতিষ্ঠানে বৈচিত্র্য এনে নতুন গতির সঞ্চার করা যেতে পারে ।
বৈচিত্র্যের স্ট্র্যাটিজি দু’ধরনের হয়ে থাকে : ক) পৃথকধর্মী বৈচিত্র্যকরণ (Conglomerate diversification) ও খ) এককেন্দ্রিক বৈচিত্র্যকরণ । প্রচলিত ব্যবসায় হতে সম্পূর্ণ নতুন ধরনের কোনো ব্যবসায় শুরু করলে যে বৈচিত্র্যের সৃষ্টি হয় তাকে পৃথকধর্মী বৈচিত্র্যকরণ বলে ।
এর অসুবিধা হলো উচ্চ নির্বাহীদের এ ধরনের ব্যবসায় সম্পর্কে ধারণা না থাকায় অন্যদের ওপর অধিক মাত্রায় নির্ভর করতে হয় । এতে প্রথমদিকে ঝুঁকির পরিমাণ বেশি থাকে । অবশ্য প্রচলিত ব্যবসায়ের সহায়তায় এরূপ ঝুঁকি অনেকটা কমানো বা বন্টন করে নেয়া সম্ভব হয়।
অন্যদিকে প্রচলিত ব্যবসায়ের বা ব্যবসায়ের উৎপাদিত পণ্যের সঙ্গে মিল রয়েছে কিন্তু তা পূর্বে করা হয়নি এমন বৈচিত্র্যকরণকে এককেন্দ্রিক বৈচিত্র্যকরণ বলে । জুতা উৎপাদনকারী কোম্পানি, ট্যানারি ব্যবসায় শুরু করলে বা জুতা উৎপাদনের সঙ্গে ব্যাগ, বেল্টসহ নতুন সামগ্রী উৎপাদন করলে তাকেও এককেন্দ্রিক বৈচিত্র্যকরণের স্ট্র্যাটিজি বলে ।
ব্যবসায় পর্যায় স্ট্র্যাটিজি(Business-level strategy)
যে ক্ষেত্রে সংস্থার অধীন কোনো নির্দিষ্ট ব্যবসায়ে বা শিল্প পর্যায়ে প্রতিযোগিতার স্বীয় সামর্থ্য বৃদ্ধি করে লক্ষ্য অর্জনের জন্য কোনো স্ট্র্যাটিজি নির্দিষ্ট করা হয় তাকে ব্যবসায় পর্যায়ের স্ট্র্যাটিজি বলে । সংস্থার অধীন কোনো নির্দিষ্ট ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে যেমনি এরূপ স্ট্র্যাটিজি নির্দিষ্ট করা যায় তেমনি কোনো স্বতন্ত্র ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানও এ ধরনের স্ট্র্যাটিজি নির্ধারণ করতে পারে । তবে এরূপ স্ট্র্যাটিজির লক্ষ্যই হলো নির্দিষ্ট ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে এর প্রতিযোগিতার সামর্থ্য বৃদ্ধি করে লক্ষ্যার্জন নিশ্চিত করা ।
Bartol 3 Martin 4, “Business-level strategy is one type of strategy that concentrates on the best means of competing within a particular business while also supporting the corporate level strategy. .”104 অর্থাৎ ব্যবসায় কেন্দ্রিক স্ট্র্যাটিজি হলো এমন এক ধরনের স্ট্র্যাটিজি যা নির্দিষ্ট ব্যবসায়ের প্রতিযোগিতার সামর্থ্য বৃদ্ধির সর্বোৎকৃষ্ট উপায় সম্পর্কে মনোনিবেশ করে। অবশ্য সংস্থার ক্ষেত্রে তা সংস্থা পর্যায়ের স্ট্র্যাটিজিকে অবশ্যই সমর্থন করে ।
ব্যবসায় পর্যায় স্ট্র্যাটিজি একটা বিশেষ ব্যবসায় ইউনিটের সঙ্গে সম্পর্কিত বিধায় যে ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে এরূপ স্ট্র্যাটিজি নির্ধারিত হয় তাকে স্ট্র্যাটীজিক ব্যবসায় ইউনিট [(Strategic business unit (SBU)] নামে অভিহিত করা হয় ।
Rue ও Holland-এর মতে “A strategic business unit (SBU) is a distinct business, with its own set of competitors, that can be managed relatively independently of other business within the organization. .”105 অর্থাৎ স্ট্র্যাটাজিক ব্যবসায় ইউনিট হলো এমন একটা পৃথক ব্যবসায় যার একটা নিজস্ব প্রতিযোগী দল থাকে যা প্রতিষ্ঠানের বা সংস্থার অধীনে অন্যান্য ব্যবসায় হতে অনেকটা স্বাধীনভাবে ব্যবসায় পরিচালনা করে ।
বাংলাদেশে বেক্সিমকো গ্রুপ-এর প্রতিষ্ঠান বেক্সিমকো ফার্মাকে অনেকটা এ ধরনের প্রতিষ্ঠান হিসেবে গণ্য করা যায় । কিন্তু বাংলাদেশ জুট মিলস্ কর্পোরেশনের অধীন কোনো একক পাটকলকে এভাবে চিন্তা করা যায় না । আবার আশরাফ টেক্সটাইল মিল্স লিমিটেড একটা নির্দিষ্ট ব্যবসায়ই পরিচালনা করে । এরূপ প্রতিষ্ঠান প্রতিযোগীদের মোকাবিলায় বিশেষ স্ট্র্যাটাজিক পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারে । সেক্ষেত্রে এটাও SBU হিসেবে গণ্য হবে ।
মাইকেল ই. পোর্টার (Michael E. Porter) নির্দিষ্ট ব্যবসায়কেন্দ্রিক স্ট্র্যাটিজিকে তিনভাগে ভাগ করেছেন ।106 এগুলোকে পোর্টারের প্রতিযোগিতামূলক স্ট্র্যাটিজিও (Porters competitive strategies) বলা হয়ে থাকে । যেকোনো নির্দিষ্ট ব্যবসায়ের ক্ষেত্রেই এর প্রয়োগ সম্ভব। নিম্নে এগুলো সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো:
i) ব্যয় নেতৃত্বমূলক স্ট্র্যাটিজি (Cost leadership strategy) :
প্রতিযোগীদের মোকাবিলায় একটা গুরুত্বপূর্ণ স্ট্র্যাটিজি হলো নিজস্ব উৎপাদিত পণ্য বা সেবার একক প্রতি ব্যয় যথাসাধ্য কম রাখার চেষ্টা করা । পণ্যের বা সেবার উৎপাদন ব্যয় যদি অন্যান্য প্রতিযোগীদের চেয়ে কম রাখা সম্ভব হয় তবে স্বাভাবিকভাবেই অন্যদের চেয়ে কমমূল্যে তা বাজারে বিক্রয় করা যায়।। এতে বাজারে চাহিদা বাড়ে, বিক্রয় বাড়ে এবং মুনাফার পরিমাণও সর্বোচ্চ হয় । এরূপ স্ট্র্যাটিজিতে সবসময়ই পণ্যের বা সেবার মান কার্যকর মানে ধরে রেখে এর উৎপাদন ব্যয়
কমানোর প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয় । এক্ষেত্রে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার, উৎপাদন পদ্ধতির বা প্রক্রিয়ার উন্নয়ন সাধন, জনশক্তির দক্ষতার উন্নয়ন, অপচয়ের পরিমাণ সর্বনিম্ন পর্যায়ে হ্রাস, বিভিন্ন উপরিব্যয় ও প্রশাসনিক খরচের ওপর কার্যকর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা, বিভিন্ন উপকরণাদি সংগ্রহের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সুবিধাজনক মূল্যে তা সংগ্রহ, খরচের অন্যান্য বিভিন্ন খাত;
যেমন- বাজারজাতকরণ প্রসার, পণ্য সরবরাহ, মূলধন সংগ্রহ সংক্রান্ত ব্যয় এবং প্রয়োজনীয় সেবামূলক খরচাদি খাতে যথাসম্ভব ব্যয় সর্বনিম্ন পর্যায়ে রাখার মাধ্যমে এরূপ স্ট্র্যাটিজি বাস্তবায়ন করা । হুন্দাই (Hyundai), কোডাক (Kodak) ইত্যাদি কোম্পানিকে এ ধরনের স্ট্র্যাটিজি গ্রহণ করতে দেখা যায় ।
ii) পৃথকীকরণ স্ট্র্যাটিজি (Differentiation strategy) :
এ ধরনের স্ট্র্যাটিজির মুখ্য বিষয় হলো পণ্য বা সেবার মান এমন হতে হবে যাতে তা প্রতিযোগীদের তুলনায় অধিক মানসম্মত হয় এবং ক্রেতাসাধারণের কাছে তা বিশেষ ইমেজ (ভাবমূর্তি) প্রতিষ্ঠা করতে পারে। মানসম্মত পণ্য বা সেবা ব্যবহারে আগ্রহী ক্রেতাসাধারণের কাছে এরূপ স্ট্র্যাটিজি বিশেষভাবে আকর্ষণীয় হয়ে থাকে। এরূপ ভাবমূর্তি একবার প্রতিষ্ঠিত হলে দীর্ঘমেয়াদে পণ্য বা সেবা বিক্রয় করে অধিক মুনাফা অর্জন সম্ভব ।
পৃথকীকরণ স্ট্র্যাটিজি বিশেষভাবে শপিং পণ্য (যা ক্রেতাসাধারণ দেখেশুনে ও দ্রব্যের গুণাগুণ যাচাই করে ক্রয় করে) ও বিশেষ মানের পণ্যের বেলায় প্রযোজ্য । সাধারণত বড়ো ধরনের বাজারকে সামনে রেখেই কোনো ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান এ ধরনের স্ট্র্যাটিজি গ্রহণ করে ।
পৃথকীকরণ পণ্যের বিভিন্ন দিক বিচারেই হতে পারে । পণ্যের গুণগতমান, ডিজাইন, প্রযুক্তিগত মান, ক্রেতাদের সেবা সুবিধা প্রদান (Customer service) ইত্যাদি বিষয় পৃথকীকরণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হয়। Rolex ঘড়ি, মার্সিডিজ বেঞ্জ (Mercedes Benz) মোটরগাড়ি, নাইকন (Nikon) ক্যামেরা ইত্যাদি পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের এ ধরনের স্ট্র্যাটিজি সকল মহলেই সুবিদিত ।
iii) কেন্দ্রীভূতকরণ স্ট্র্যাটিজি (Focus strategy) :
এ ধরনের স্ট্র্যাটিজি বাজার সম্পর্কিত । বিশেষ ধরনের ক্রেতাদের ওপর বা নির্দিষ্ট অঞ্চলের বাজারের ওপর নিজের সম্পূর্ণ আধিপত্য প্রতিষ্ঠার স্ট্র্যাটিজিকে কেন্দ্রীভূতকরণ স্ট্র্যাটিজি বলে । এক্ষেত্রে নিজেদের চিন্তা ও প্রচেষ্টাকে ব্যাপক-বিস্তৃত বাজারের ওপর নিবন্ধ না করে নির্দিষ্ট বাজারের ওপর নিবন্ধ করা হয় ।
এক্ষেত্রে এই নির্দিষ্ট বাজারে নিজস্ব প্রভাব সৃষ্টির জন্য ব্যয় নেতৃত্বমূলক স্ট্র্যাটিজি বা পৃথকীকরণ স্ট্র্যাটিজি বা উভয়েরই সহায়তা নেয়া হয়ে থাকে । এতে ঐ বাজারের ক্রেতাসাধারণ উক্ত প্রতিষ্ঠানের পণ্যকেই একক পণ্য হিসেবে গ্রহণ করে। ফলে অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের পক্ষে ঐ বাজারে প্রবেশ খুবই কষ্টসাধ্য হয়ে থাকে। আমাদের দেশে একসময় মোটরসাইকেল বলতে মানুষ হোন্ডা মোটরসাইকেলকেই বুঝতো। লুব্রিকেন্ট অয়েলকে এক সময় এদেশে মবিল বলা হতো এরূপ স্ট্র্যাটিজির কারণেই ।
ইটালি ও ইউরোপের কতিপয় নির্দিষ্ট দেশে ফিয়াট (Fiat) মোটর গাড়ি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ব্যয়ের নেতৃত্বমূলক নীতির অনুসরণে ব্যাপক ইমেজ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে। লনজিনেস (Longines) নামক ঘড়ি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ইউরোপ ও আমেরিকার বিশেষ মানের মহিলা ক্রেতাদের মাঝে পৃথকীকরণ স্ট্র্যাটিজির ব্যবহার করে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভে করেছে ।
কর্মক্ষেত্র পর্যায় স্ট্র্যাটিজি (Functional-level strategy)
ব্যবসায় পর্যায়ে (Business-level) যে সকল স্ট্র্যাটিজি নির্ধারণ করা হয় বাস্তবায়নের পর্যায়ে গিয়ে অনেক সময়ই আবার বিভিন্ন ধরনের স্ট্র্যাটিজি গ্রহণের প্রয়োজন পড়ে। একে কর্মক্ষেত্র পর্যায় স্ট্র্যাটিজি বলা হয় । Bartol 8 Martin, “Functional-level strategy focuses on action plans for managing
particular functional area within a business in a way that supports business level strategy.” 107 অর্থাৎ কর্মক্ষেত্র পর্যায় স্ট্র্যাটিজি প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায় পর্যায়ের স্ট্র্যাটিজি বাস্তবায়নের জন্য এর বিভিন্ন নির্দিষ্ট কর্মক্ষেত্র বা বিভাগের বাস্তবায়নধর্মী পরিকল্পনার সঙ্গে সম্পৃক্ত ।
লেখকদ্বয় প্রতিষ্ঠানের এরূপ কর্মক্ষেত্র বলতে প্রধান কার্যক্ষেত্রসমূহ; যেমন- উৎপাদন, বাজারজাতকরণ, অর্থসংস্থান, মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা, হিসাব বিজ্ঞান, গবেষণা ও উন্নয়ন ইত্যাদি কার্য বা বিভাগসমূহকে নির্দিষ্ট করেছেন । অর্থাৎ এ সব বিভাগীয় কার্যাবলি সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের ওপর প্রতিষ্ঠানের উচ্চ পর্যায়ে বা প্রতিষ্ঠান পর্যায়ে যে স্ট্র্যাটিজি নির্ধারিত হয় তার বাস্তবায়ন নির্ভর করে । বাস্তবায়ন পর্যায়ে গিয়ে এ সকল কর্মক্ষেত্রে বিভি ধরনের স্ট্র্যাটিজি নির্ধারণের প্রয়োজন দেখা দেয় । এগুলোকেই কর্মক্ষেত্র পর্যায়ের স্ট্র্যাটিজি বলে ।

যদি কোনো প্রতিষ্ঠান ব্যয় নেতৃত্বমূলক স্ট্র্যাটিজি নির্দিষ্ট করে তবে এর সকল পর্যায়ে কীভাবে ব্যয় কমানো যাবে বা ব্যয়ের ওপর সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা যাবে এজন্য কর্মক্ষেত্রে স্ট্র্যাটিজি নির্দিষ্ট করার প্রয়োজন দেখা দেবে ।
ধরা যাক, কোনো প্রতিষ্ঠানে ব্যয় কমানোর জন্য যদি উৎপাদন প্রক্রিয়ায় আরো আধুনিকীকরণের প্রয়োজন পড়ে, বিভিন্ন পর্যায়ে প্রয়োজনাতিরিক্ত কর্মী সনাক্তকরণ ও ছাঁটাই করার দরকার হয় এবং বিভিন্ন পর্যায়ে নিয়োজিত কর্মী ও কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া আবশ্যক বিবেচিত হয়, তবে সেক্ষেত্রে এর প্রতিটি কাজ কীভাবে সুচারুরূপে সম্পন্ন করা যাবে তজ্জন্য কর্মক্ষেত্র পর্যায়ে স্ট্র্যাটিজি নির্ধারণ অত্যাবশ্যক । বিভিন্ন মনীষী স্ট্র্যাটিজিকে উপরোক্ত বিভিন্ন ভাগে ভাগ করলেও Weinrich ও Koontz প্রতিষ্ঠানের স্ট্র্যাটিজিকে কতগুলো প্রধানভাগে ভাগ করেছেন । যা নিম্নরূপ :
১. প্রবৃদ্ধি অর্জনের স্ট্র্যাটিজি (Growth strategy);
২. আর্থিক স্ট্র্যাটিজি (Finance strategy);
৩. সংগঠন সংক্রান্ত স্ট্র্যাটিজি (Organization strategy);
৪. কর্মী সংক্রান্ত স্ট্র্যাটিজি (Personnel strategy);
৫. জনসংযোগ স্ট্র্যাটিজি (Public relations strategy);
৬. পণ্য বা সেবা সংক্রান্ত স্ট্র্যাটিজি (Products or services strategy) ; ও
৭. বাজারজাতকরণ স্ট্র্যাটিজি (Marketing strategy) ।
উল্লিখিত স্ট্র্যাটিজিসমূহের মধ্যে প্রবৃদ্ধি অর্জনের স্ট্র্যাটিজি বাদ দিলে আর সবগুলোই মূলত কর্মকেন্দ্রিক স্ট্র্যাটিজি হিসেবে গণ্য করা যায় । অবশ্য বড় বড় প্রতিষ্ঠানে এ সকল বিষয়ে দীর্ঘমেয়াদে স্ট্র্যাটিজি নির্ধারণ করা হতে পারে । সেক্ষেত্রে তা নির্দিষ্ট ব্যবসায়কেন্দ্রিক স্ট্র্যাটিজির আওতায় পড়তে পারে ।
আরও দেখুনঃ