আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় শিল্প বিরোধ আইন। এই পাঠটি “ইন্ডাস্ট্রিয়াল ম্যানেজমেন্টে” বিষয়ের “শ্রম ও শিল্প আইন” বিভাগের একটি পাঠ।
Table of Contents
শিল্প বিরোধ আইন
শিল্প সংগঠনে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত দুটি পক্ষ মালিক বা ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ এবং শ্রমিক সম্প্রদায়। এ দুটি পক্ষের মধ্যে সৃষ্ট বিরোধ নিষ্পত্তিকল্পে যে আইন প্রণীত তাই শিল্প বিরোধ আইন। বর্তমানে বাংলাদেশে ১৯৬৯ সালের শিল্প সম্পর্ক অধ্যাদেশ কিছুটা পরিমার্জিত ও সংশোধিত আকারে চালু রয়েছে।
(ক) শিল্প বিরোধের সংজ্ঞা (Definition of industrial dispute) ঃ
সাধারণ অর্থে- শিল্প ক্ষেত্রে শ্রমিক-মালিকের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট দ্বন্দ্বকেই শিল্প বিরোধ বলা হয় । ব্যাপক অর্থে- নিয়োগকারীর সাথে কর্মীর, কর্মীর সাথে কর্মীর, ব্যবস্থাপনার সাথে শ্রমিকসংঘের অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও ব্যবস্থাপনাগত বিষয়ে যে বিরোধ দেখা দেয়, তাকে শিল্প বিরোধ বলে । উপরোক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এটি স্পষ্টই প্রতীয়মান হয় যে, শিল্প বিরোধ এমন একটি প্রক্রিয়া, যা নিয়োগকারী বা ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের সাথে শ্রমিক-কর্মীর দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়।
(খ) শিল্প বিরোধের কারণ (Causes of indulrial dispute) :
যে সকল কারণের প্রেক্ষিতে শিল্প বিরোধ সংঘটিত হয়ে থাকে নিম্নে তা উপস্থাপন করা হল-
অর্থনৈতিক কারণসমূহ ঃ শ্রম বিরোধের অর্থনৈতিক কারণগুলো নিচে আলোচনা করা হল :
১। মজুরি ও ভাতাদি বৃদ্ধির দাবি (Increase of wages and allowance) ঃ
শ্রমিকরা যখন বর্তমান প্রাপ্ত মজুরি বা ভাতাদি অপর্যাপ্ত মনে করে তখনই তাদের মধ্যে অসন্তোষ দানা বাঁধে। শিল্প কারখানায় অধিকাংশ বিক্ষোভ ও সংঘাত এ
কারণেই সংঘটিত হয়।
২। চাকরির নিরাপত্তা (Job security) :
চাকরির নিরাপত্তা সম্বন্ধে কর্মীরা সবসময়ই উদ্বিগ্ন থাকে। এটি তাদের চাকরির স্থায়িত্বের সাথে সম্পর্কিত। মানুষ সবসময় তার জীবিকার উৎসটি নিরাপদ থাকুক তা কামনা করে। ব্যবস্থাপকের চ্ছা ও অনিচ্ছার উপর চাকরিচ্যুতি, ছাঁটাই প্রভৃতি যাতে সংঘটিত না হয় সেজন্য কর্মীরা সংঘবদ্ধ হয় এবং প্রয়োজনে
বিরোধে লিপ্ত হয়।
৩। বোনাস ও মুনাফায় শরিকানা দাবি (Bonus and profit sharing) :
কিছু কিছু শিল্পপ্রতিষ্ঠান কর্মচারী ও শ্রমিকদেরকে উৎসবাদিতে বোনাস এবং লভ্যাংশের নির্দিষ্ট অংশ বোনাস হিসেবে প্রদান করে থাকে। এসব নজির প্রদর্শন করে বাকি সব প্রতিষ্ঠান উৎসব ও মুনাফা বোনাসের দাবিতে মালিকের বিরুদ্ধে শ্লোগান তোলে। এ দাবি উপেক্ষিত হলে শ্রমিকদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়।
৪। অতিরিক্ত কার্যের জন্য ভাতা দাবি (Allowances for extra work)ঃ
অতিরিক্ত সময় কাজের জন্য শ্রমিকদের অর্থ দেয়ার নিয়ম রয়েছে। এ অর্থ প্রদানে অস্বীকৃতি জানালে অথবা প্রদত্ত অর্থ যথাযথ না হলে তা বৃদ্ধিকল্পে কর্মীরা আন্দোলন করে থাকে।
৫। মহার্ঘ ভাতা ও প্রাজিক সুবিধাদি (Dearnen allowances and fringe benefit) :
দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়ার লাগাম ধরে রাখা আমাদের দেশে কোন সরকারের পক্ষেই সম্ভব হচ্ছে না। দ্রব্যমূল্যের নিষ্পেষণে নির্দিষ্ট আয়ের কর্মীদের জীবন বিপন্ন। তাই কর্মীরা মহার্ঘ ভাতা ও প্রান্তিক সুবিধা বৃদ্ধির জন্য দাবি তুলে।
মনস্তাত্ত্বিক কারণ (Psychological causes) :
বর্তমান মালিক-শ্রমিকের দ্বন্দ্ব অনেকটা মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে । মনস্তাত্ত্বিক কারণে যে সকল সমস্যা সৃষ্টি হয় তা নিচে আলোচনা করা হল ঃ
১। যোগাযোগের বাধা (Communication barrier) :
উত্তম যোগাযোগের অভাব ব্যবস্থাপনা ও শ্রমিক সংঘের সম্পর্কের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা। শ্রমিকরা অনেক সময় তাদের চাকরির নিরাপত্তার সম্বন্ধে অবগত থাকে না। যোগাযোগের প্রতিবন্ধকতা শিল্প সংঘাতের অন্যতম কারণ।
২। ভ্রান্ত প্রত্যক্ষণ (Foulty perception) :
প্রত্যক্ষণের মাধ্যমে ব্যক্তি বা দল তাদের উদ্দেশ্যমূলক আচরণকে কার্যকর করে। মানুষের প্রত্যক্ষণের বহিঃপ্রকাশ ঘটে তার আচরণ ও কার্যে। ভুল প্রত্যক্ষণের প্রভাবে ব্যক্তি কোন বিষয় বা বস্তু সম্বন্ধে ভুল ধারণা পোষণ করে। ফলে শ্রমিক ও ব্যবস্থাপক পক্ষ সমস্যার সঠিক সমাধান দিতে ব্যর্থ হয় এবং শিল্প বিরোধ দেখা দেয়।
৩। মনস্তাত্ত্বিক অভাব পূরণে ব্যর্থতা (Failure in satisfying psychological needs) :
কর্মী কাজের মাধ্যমে তার অভাব পূরণের প্রত্যাশা করে। এ অভাবগুলো জৈবিক, সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক প্রকৃতির হয়ে থাকে। আমাদের শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপকরা কর্মীদের অভাব, মনোভাব, দক্ষতা প্রভৃতি বুঝবার মতো দক্ষ ও অভিজ্ঞ নয়। এ কারণে এক পক্ষ অপর পক্ষের অবস্থা বুঝতে চায় না ফলে শ্রমিক অসন্তোষ প্রকট আকার ধারণ করে।
৪। আঞ্চলিকতার প্রভাব (Effect of regionalism) :
অধুনা আমাদের শিল্প এলাকায় আঞ্চলিকতার প্রভাব অত্যন্ত প্রকট। এ আঞ্চলিকতা শ্রমিকদের মধ্যকার দন্দ্ব সৃষ্টির অন্যতম কারণ।
৫। রাজনৈতিক কারণ (Political causes) ঃ
দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ শিল্পপ্রতিষ্ঠানেও প্রভাব বিস্তার করে। যে সকল রাজনৈতিক কারণ শিল্পশান্তি বিনষ্ট করে তা নিচে আলোচনা করা হল ঃ
(i) শ্রমিকসংঘ অনুমোদনের দাবি ঃ
(Right for trade union) : স্বীয় অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক স্বার্থ সংরক্ষণ ও দাবি আদায়কল্পে শ্রমিকরা সংঘে যোগদান করে। কর্তৃপক্ষ শ্রমিকসংঘকে অনুমোদন দানে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করলে শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দেয়।
(ii) রাজনৈতিক দলের প্রভাব (Effect of political partices) :
প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক কারণেও অনেক সময় সংঘর্ষ দেখা দেয়। শ্রমিকসংঘ প্রায়ই রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থনপুষ্ট হয়ে থাকে। তাই কোন রাজনৈতিক দল বা নেতার সমর্থনে শ্রমিকরা প্রতীক ধর্মঘটের মাধ্যমে তাদের সমর্থন জ্ঞাপন করে।
(III) সহানুভূতিমূলক কারণ (Sympathetic reasours) ঃ
অনেক সময় এক প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা অন্য প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের দাবিদাওয়ার প্রতি সমর্থন ও সহানুভূতি জ্ঞাতার্থে ধর্মঘটে লিপ্ত হয় ।
অন্যান্য কারণ (Other couses) ঃ
অন্য কারণগুলোর মধ্যে নিচের বিষয়গুলো বিশেষ উল্লেখযোগ্য ও
(iv) চাকরির শর্তাবলি ( Employment condition) ঃ
চাকরির শর্তাবলি ব্যক্ত ও অব্যক্ত হতে পারে। যে সকল প্রতিষ্ঠানে চাকরির শর্তাবলি অব্যক্ত থাকে সেখানে শ্রম বিরোধের সম্ভাবনা বেশি।
(v) স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশের দাবি (Healthy environment) ঃ
কারখানার স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ রক্ষাকল্পে বাতাস ও পানি দূষণ থেকে রক্ষা করতে হবে। কর্মীরা শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি হতে নিজেদেরকে রক্ষা করতে চায়।
(vi) পেশাগত নিরাপত্তা (Profesional security) ঃ
শ্রমিকদের পেশাগত নিরাপত্তার জন্য যন্ত্রপাতিকে সঠিক ফেন্সিং দিয়ে রাখতে হবে যেন দুর্ঘটনা হ্রাস পায় এ বিষয়ে কারখানা আইন পুরোপুরি না মানার জন্য শিল্প বিরোধ দেখা দেয় ।
(vii) শ্রমিক সেবার দাবি : (Employee servies) ঃ
কর্তৃপক্ষ কর্মীদের জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিত্তবিনোদন প্রভৃতি ব্যবস্থা করবে এটি তারা আশা করে। এ সুবিধার অভাবে তাদের মনে বৈরিভাব দানা বাঁধতে থাকে।
(viii) চুক্তি ভঙ্গ (Break of contract) ঃ
ব্যবস্থাপকদের সাথে পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় কর্তৃপক্ষ তা ভঙ্গ করলে কর্মীদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয় যা শিল্প বিরোধের রূপ নেয় ।
(ix) কর্মনীতি বৈষম্য (Discrimination is personal policies) ঃ
কর্মীদের পদোন্নতি, বদলি, প্রশিক্ষণে প্রেরণ প্রভৃতি বিষয়ে বৈষম্যমূলক নীতি অবলম্বন করলে শিল্প বিরোধ দেখা দেয়।
আরও পড়ূনঃ