স্ট্র্যাটীজিক পরিকল্পনা প্রণয়নে বা স্ট্র্যাটিজি নির্ধারণে বিবেচ্য বিষয়সমূহ নিয়ে আজকের আলোচনা। এই পাঠটি “ব্যবস্থাপনা নীতিমালা” বিষয়ের ” পরিকল্পনা” বিষয়ক পাঠের অংশ। দীর্ঘমেয়াদি স্ট্র্যাটাজিক পরিকল্পনা প্রণয়নে বা স্ট্র্যাটিজি নির্ধারণে শীর্ষ নির্বাহীদের যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। কারণ এরূপ পরিকল্পনার কার্যকারিতার ওপর দীর্ঘমেয়াদে প্রতিষ্ঠানের সাফল্য নির্ভর করে। প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক বিভিন্ন বিষয় স্ট্র্যাটাজিক পরিকল্পনা প্রণয়নে বিবেচনার প্রয়োজন পড়ে । নিম্নে বিবেচ্য বিষয়সমূহ উল্লেখ করা হলো :
Table of Contents
স্ট্র্যাটীজিক পরিকল্পনা প্রণয়নে বা স্ট্র্যাটিজি নির্ধারণে বিবেচ্য বিষয়সমূহ
১. স্ট্র্যাটাজিক লক্ষ্য (Strategic goal) :
স্টাটাজিক পরিকল্পনা প্রণয়নে প্রথমেই প্রতিষ্ঠানের স্ট্র্যাটীজিক লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয় এবং এরূপ লক্ষ্য বিবেচনায় এনেই স্ট্র্যাটাজিক পরিকল্পনা প্রণীত হয় । মূলত স্ট্র্যাটাজিক লক্ষ্য কতদিনে এবং কীভাবে অর্জন করা যাবে সেদিকে খেয়াল রেখেই পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়ে থাকে ।
আগামী ১০ বছরে যদি প্রতিষ্ঠানের বিক্রয়ের পরিমাণ ১০ গুণ বৃদ্ধির স্ট্র্যাটীজিক লক্ষ্য ধার্য হয় তবে তা অর্জনের স্টাটীজিক পরিকল্পনা কী হতে পারে তা নির্দিষ্ট করার প্রয়োজন পড়ে। এজন্য পণ্যসারি সম্প্রসারণ, পণ্যের মানোন্নয়ন, নতুন বাজারে প্রবেশ, পণ্যের মূল্য হ্রাস, ব্যাপক বাজারজাতকরণ কর্মসূচি গ্রহণ ইত্যাদি বিষয়ে স্ট্র্যাটাজিক পরিকল্পনা নিতে হয় ।
২. প্রতিষ্ঠানের বর্তমান অবস্থা (Present condition of organization) :
স্ট্যাটীজিক পরিকল্পনা প্রণয়নে প্রতিষ্ঠানের বর্তমান অবস্থা, বিদ্যমান সুবিধা ও অসুবিধা, সাংগঠনিক শক্তি ও দুর্বলতা ইত্যাদি বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হয়। এক্ষেত্রে পরিকল্পনাবিদদের সবসময়ই স্মরণ রাখতে হয় যে, বর্তমানকে বাদ দিয়ে কখনই ভবিষ্যৎ রচনা করা যায় না । কারণ বর্তমান অবস্থা ভবিষ্যতের ভিত্তিমূল হিসেবে কাজ করে ।
৩. প্রাতিষ্ঠানিক প্রবৃদ্ধির হার (Growth rate of organization) :
এ ধরনের পরিকল্পনা প্রণয়নে প্রাতিষ্ঠানিক প্রবৃদ্ধির হারও বিবেচনা করা উচিত । বিগত বছরগুলোতে উৎপাদন, বিক্রয়, মুনাফা ইত্যাদি ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধির হার কেমন ছিল তা বিবেচনায় আনা না হলে পরিকল্পনা বাস্তবতা বিবর্জিত হওয়া খুবই স্বাভাবিক । এক্ষেত্রে অতীতে গৃহীত পরিকল্পনা ও তার কার্যকারিতাও পরিমাপ করা প্রয়োজন ।
৪. ভবিষ্যৎ পরিবেশগত অবস্থা (Future environmental condition) :
ভবিষ্যতে প্রাকৃতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, প্রযুক্তিগত ইত্যাদি বিভিন্নমুখী পরিবেশ কেমন হতে পারে দীর্ঘমেয়াদি স্ট্র্যাটীজিক পরিকল্পনা প্রণয়নে তাও অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হয়। এজন্য অতীতের বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণের পাশাপাশি বিভিন্নমুখী তথ্য সংগ্রহেরও প্রয়োজন পড়ে। এক্ষেত্রে সুবিধাজনক ও অসুবিধাজনক সকল দিকের চুলচেরা বিশ্লেষণ করে যথাযথ পটভূমি নির্ণয় করতে হয়। বৃহদায়তন প্রতিষ্ঠানগুলো এক্ষেত্রে বিশ্ব বাণিজ্য পরিস্থিতিও বিবেচনায় আনে।

৫. প্রতিযোগীদের অবস্থা ও তাদের রণকৌশল (Competitior’s position and their strategy) :
এ ধরনের পরিকল্পনা প্রণয়নের প্রধান উদ্দেশ্য হলো, দীর্ঘমেয়াদি প্রতিযোগিতায় নিজস্ব অবস্থান সংহত করে বাজারের ওপর নিজস্ব কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা ও তা বজায় রাখা। এ উদ্দেশ্য অর্জনে অবশ্যই প্রতিযোগীদের বর্তমান অবস্থা, ভবিষ্যতে তারা কী ধরনের স্ট্র্যাটাজিক পরিকল্পনা নিচ্ছে তা যথার্থভাবে মূল্যায়নের প্রয়োজন পড়ে। ব্যবসাকে একটা যুদ্ধ ধরা হলে শত্রুরা কোন্ ধরনের স্ট্র্যাটিজি নিয়ে আমাদেরকে ঘায়েল করতে চাচ্ছে পরিকল্পনা প্রণয়নকালে তা অবশ্যই খুবই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত হওয়া আবশ্যক ।
৬. বাজারে নতুন প্রতিযোগী আসার সম্ভাবনা (Possibility of new competitors entrance) :
বর্তমান প্রতিযোগীদের অবস্থা নিয়ে শুধুমাত্র চিন্তা করলেই চলে না দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়নে বাজারে নতুন প্রতিযোগী আসার সম্ভাবনা কেমন তাও বিবেচনা করতে হয় । বর্তমানকালে মুক্তবাজার অর্থনীতিতে প্রতিযোগিতা শামিল হয় । তাই ভবিষ্যতে এমন প্রতিযোগিতায় কারা, কীভাবে আসতে পারে তাও অবশ্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ। দেশের অভ্যন্তরেই শুধুমাত্র সীমাবদ্ধ থাকে না বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানগুলোও প্রতিযোগিতায় বিবেচ্য বিষয় । মধ্যেই প্রতিযোগিতা চলে না বিকল্প পণ্যের উৎপাদনকারী বা বিক্রেতারাও গুরুত্বপূর্ণ প্রতিযোগী হিসেবে বিবেচিত
৭. বিকল্প পণ্যের অবস্থা (Condition of substitute products:
বর্তমানকালে শুধু সমধর্মী প্রতিষ্ঠানগুলোর হয়। বিকল্প পক্ষগুলো ভবিষ্যতে কেমন ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে, তারা প্রতিযোগী বিকল্প পণ্যগুলোর বিরুদ্ধে কী ধরনের ট্র্যাটিজি নিতে পারে তাও বিবেচনায় আনতে হয়। আমাদের দেশের পাটশিল্প মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পিছনে বিকল্প পণ্যের উন্নয়ন ও তার প্রসার মুখ্য ভূমিকা রেখেছে ।
৮. ক্রেতা বা ভোক্তাদের অবস্থা (Condition of buyers or consumers ) :
স্ট্র্যাটীজিক পরিকল্পনা প্রণয়নে ক্রেতা ও ভোক্তাদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ অবস্থা, ক্রেতাদের চাহিদা ও রুচি পরিবর্তনের ধারা, তাদের ক্রয় সামর্থ্য ইত্যাদি বিষয়ও এক্ষেত্রে বিশেষভাবে বিবেচনায় আনার প্রয়োজন পড়ে। সামগ্রিক পণ্য বাজারের সঙ্গে কী পরিমাণ নতুন ক্রেতা বা ভোক্তা সম্পৃক্ত হতে পারে তাও বিবেচনায় আনা আবশ্যক ।
৯. প্রাতিষ্ঠানিক উপকরণাদির প্রাপ্যতা (Availability of required resources) :
প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পৃক্ত উপকরণাদি ভবিষ্যতে পাওয়ার সম্ভাবনা কেমন থাকবে তাও এরূপ পরিকল্পনা নির্ধারণে বিবেচনা করতে হয়। প্রতিষ্ঠানের সম্প্রসারণের প্রয়োজনে নতুন ভূমি পাওয়া যাবে কিনা, প্রয়োজনীয় অর্থ সরবরাহ পরিস্থিতি কেমন থাকবে, কাঁচামাল ও শ্রমিক কর্মী সরবরাহ পরিস্থিতি সন্তোষজনক হবে কিনা ইত্যাদি বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনার প্রয়োজন ।
উপরোক্ত বিষয়গুলো যথাযথ বিবেচনায় এনে স্ট্র্যাটাজিক পরিকল্পনা গ্রহণ করা হলে এর দ্বারা প্রতিষ্ঠান তার স্ট্যাটীজিক লক্ষ্য অর্জন করতে পারে। অন্যথায় ভবিষ্যৎ প্রয়োজনের সঙ্গে সঙ্গতি বিধানে এরূপ পরিকল্পনা ব্যর্থ হয় । ফলে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে ব্যবসায় মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে থাকে ।
আরও দেখুনঃ