ব্যবস্থাপকীয় দক্ষতা পরিমাপের ভিত্তিসমূহ নিয়ে আজকের আলোচনা। এই পাঠটি “ব্যবস্থাপনা নীতিমালা” বিষয়ের ” ব্যবস্থাপনার পরিচিতি” বিষয়ক পাঠের অংশ। ব্যবস্থাপকীয় দক্ষতার বিষয়টি পরিমাপ করা বেশ জটিল বিষয়। কারণ এরূপ দক্ষতার বিষয়টি পরিমাপের কোনো একক ও নির্দিষ্ট পরিমাপক নেই।
অইরিক ও কুঞ্জ বলেছেন,
“Effectiveness is the achievement of objective. Efficiency is the achievement of the ends with the least amount of resources.” অর্থাৎ উদ্দেশ্যের অর্জনই হলো ফলপ্রদতা এবং ন্যূনতম পরিমাণ উপকরণ ব্যবহার করে উদ্দেশ্য অর্জন করতে পারাই হলো দক্ষতা।
Table of Contents
ব্যবস্থাপকীয় দক্ষতা পরিমাপের ভিত্তিসমূহ
ব্যবসায় একটি দীর্ঘমেয়াদি কর্ম প্রক্রিয়া; তাই দু’এক বছরের কার্যফল দিয়ে তা পরিমাপ করা সম্ভব নয়। তবে একটা প্রতিষ্ঠান কতটা সাফল্যের সঙ্গে তার উদ্দেশ্য অর্জন করতে পারছে তা দিয়ে ব্যবস্থাপকদের দক্ষতা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। নিম্নে ব্যবস্থাপকীয় দক্ষতা পরিমাপের বিভিন্ন ভিত্তি সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
১. মুনাফার পরিমাণ (Amount of profit) :
যে কোনো ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের মূল লক্ষ্য হলো মুনাফা অর্জন । তাই মুনাফা অর্জনের পরিমাণ, মূলধন বিবেচনায় মুনাফার হার এবং বিগত বছরগুলোর মুনাফা বৃদ্ধির প্রবণতা বিবেচনায় এনে কোনো প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনার দক্ষতা পরিমাপ করা যায়। অবশ্য প্রতিযোগিতামূলক বাজারে দক্ষতা পরিমাপে এরূপ ভিত্তি অধিক গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হয়ে থাকে। এরূপ বাজারে যদি মুনাফার প্রবৃদ্ধি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায় তবে তা ব্যবস্থাপনার দক্ষতারই প্রমাণ করে ।
২. উৎপাদনশীলতার হার (Rate of productivity) :
ব্যবস্থাপনার দক্ষতা পরিমাপের ক্ষেত্রে উৎপাদনশীলতা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি হিসেবে গণ্য। অইরিক ও কুঞ্জ বলেছেন, “Productivity means the output-input ratio within a time period with due consideration for quality.” 69 অর্থাৎ নির্দিষ্ট সময়ে পণ্যের পূর্বতন মান বজায় রেখে ব্যয় ও প্রাপ্তির অনুপাতকে উৎপাদনশীলতা বলে।
কর্মীপিছু উৎপাদনশীলতা ধরা হলে যদি একজন শ্রমিকের বেতন হয় ১০০ টাকা এবং সে ২০০ টাকার পণ্য উৎপাদন করে তবে উৎপাদনশীলতা হবে : এখন যদি কর্মীদেরকে প্রশিক্ষণ দান, উন্নত যন্ত্রপাতি ব্যবহার ইত্যাদি নানানভাবে শ্রমিক পিছু ব্যয়ের তুলনায় প্রাপ্তি বা উৎপাদনের পরিমাণ বা হার যদি বাড়তে থাকে তবে তা ব্যবস্থাপনা দক্ষতার প্রমাণ করে ।
৩. বিক্রয়ের পরিমাণ (Amount of sale) :
পণ্য বা সেবা বিক্রয়ের পরিমাণ ও এক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধির হার বিবেচনা করেও ব্যবস্থাপকীয় দক্ষতা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় । প্রতিযোগিতাপূর্ণ বাজারে নিজস্ব পণ্য বা সেবার চাহিদা ধরে রেখে তা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি করতে পারাটা সাফল্য অর্জনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ জন্য ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানগুলো নানান কার্যক্রম গ্রহণ করে। মূলধন বিবেচনায় বিক্রয়ের হার, পরিসম্পদ তুলনায় বিক্রয়ের হার এবং বিগত বছরগুলোর বিবেচনায় এ সকল সূচকে প্রবৃদ্ধির হার দক্ষতা পরিমাপে বিশেষভাবে বিবেচনা করা যায়।

৪. ব্যবহৃত কৌশল বা প্রযুক্তির মান (Quality of technique or technology used) :
ব্যবহৃত কৌশল ও প্রযুক্তির মান বিবেচনা করেও ব্যবস্থাপনার দক্ষতা পরিমাপ করা যায় । দক্ষ ব্যবস্থাপকগণ সব সময়ই প্রতিষ্ঠানে উন্নত পদ্ধতি, কৌশল ও প্রযুক্তি ব্যবহারের চেষ্টা চালায়। উৎপাদন বৃদ্ধি, উন্নতমানের পণ্য উৎপাদন এবং প্রতিযোগিতার সমর্থ ধরে রাখার জন্য বর্তমানকালে সমজাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে উন্নত কৌশল ও প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রতিযোগিতা চলছে। আধুনিকমনস্ক ও দক্ষ ব্যবস্থাপকগণকে উন্নত কৌশল ও প্রযুক্তি ব্যবহারে সবসময়ই তৎপর দেখা যায়।
৫. প্রতিষ্ঠানের কার্য পরিবেশ (Working environment of the organization) :
উৎপাদনমুখী কার্য পরিবেশ যেকোনো প্রতিষ্ঠানের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হয়। প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ ভৌত সুযোগ-সুবিধা, উপকরণ ও প্রক্রিয়াদির যথাযথ বিন্যাস ও সাজ-সজ্জা, উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা, আনুগত্য ও শৃঙ্খলা, পারস্পরিক শ্রদ্ধা, দলীয় চেতনা ইত্যাদি বিষয়ের ওপর এরূপ পরিবেশ নির্ভরশীল । দক্ষ ব্যবস্থাপকের পক্ষেই প্রতিষ্ঠানে এরূপ কর্ম পরিবেশ সৃষ্টি ও বজায় রাখা সম্ভব ।
৬. কর্মী-ব্যবস্থাপনা সম্পর্ক (Employee management relationship ) :
প্রতিষ্ঠানে কর্মী-ব্যবস্থাপনা বা শ্রম-ব্যবস্থাপনা সম্পর্ক বিবেচনা করেও ব্যবস্থাপনার দক্ষতা পরিমাপ করা যায়। যেকোন প্রতিষ্ঠানে কর্মীদের স্বতঃস্ফূর্ত, আন্তরিক ও সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টার ওপর এর সাফল্য নির্ভরশীল। কর্মীদের নিকট থেকে এরূপ আচরণ তখনই প্রত্যাশা করা যায় যখন প্রতিষ্ঠানে উত্তম কর্মী-ব্যবস্থাপনা সম্পর্ক বিরাজ করে। ব্যবস্থাপনা দক্ষ হলে তা শ্রমিক-কর্মীদের সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করে তাদের শ্রদ্ধা অর্জন করতে পারে। ফলে প্রতিষ্ঠানে শ্রম অসন্তোষের কোনো সুযোগ থাকে না ।
৭. সামাজিক দায়িত্ব পালন (Observance of social responsibility) :
মুনাফা অর্জনের পাশাপাশি একটা প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা সামাজিক দায়িত্ব পালনে কতটা যত্নবান তা দিয়েও এর দক্ষতা বিচার করা যায় । উন্নতমানের পণ্য সরবরাহ, সর্বোচ্চ গ্রাহক সেবা প্রদান এবং শ্রমিক-কর্মী, সরবরাহকারী, নিজস্ব সম্প্রদায়, সরকার, প্রতিবেশী ইত্যাদি বিভিন্ন পক্ষের প্রতি দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠান এ দায়িত্ব পালন করতে পারে । যার ফলে এর ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে জনমনে ইতিবাচক ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। তাই সামাজিক দায়িত্ব পালনের আগ্রহ ও প্রচেষ্টার মধ্য দিয়েও দক্ষ ব্যবস্থাপনার পরিচয় মিলে।
উপসংহারে বলা যায়, ব্যবস্থাপনার দক্ষতা সাধারণভাবে কোনো দৃশ্যমান বিষয় নয় যা এর কর্মপ্রচেষ্টার সাফল্য দ্বারাই অনুভব করা সম্ভব। আর এরূপ বিবেচনায় উপরিউক্ত বিষয়গুলো বিবেচনা সাপেক্ষ। যেই ব্যবস্থাপকগণ যুগের চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে উক্ত বিষয়গুলোতে ইতিবাচক ফলাফল বা প্রবৃদ্ধি দীর্ঘমেয়াদে ধরে রাখতে পারে দক্ষতার মানদণ্ডে তাদেরকেই উত্তম হিসেবে গণ্য করা যায় ।
আরও দেখুনঃ