বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যবস্থাপনার ভূমিকা নিয়ে আজকের আলোচনা। এই পাঠটি “ব্যবস্থাপনা নীতিমালা” বিষয়ের ” ব্যবস্থাপনার পরিচিতি” বিষয়ক পাঠের অংশ। বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। শিল্প-কারখানা ও ব্যবসা-বাণিজ্য এখানে এখনও তেমন প্রসার লাভ করেনি। জনশক্তি, উর্বর ভূমি ও প্রাকৃতিক সম্পদে এ দেশ সমৃদ্ধ হলেও দক্ষ ব্যবস্থাপনার অভাবে আমরা তা কাজে লাগাতে পারছি না । তারপরও যতটুকু উন্নতি হয়েছে সেক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনার ভূমিকা অস্বীকার করার উপায় নেই । নিম্নে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যবস্থাপনার ভূমিকা আলোচনা করা হলো :
Table of Contents
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যবস্থাপনার ভূমিকা
১. উপকরণাদির ব্যবহার (Utilisation of resources) :
ভূমি, শ্রম, মূলধন ইত্যাদি উপাদান কোথাও থাকাই যথেষ্ট নয় । এর যথাযথ সদ্ব্যবহারের জন্য দক্ষ ব্যবস্থাপনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ । আমাদের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা দুর্বল হওয়ার কারণে আজ জনশক্তি জনসম্পদে পরিণত হতে পারছে না। মাটির নিচের খনিজ সম্পদ আজও অনাবিষ্কৃত । যাওবা আবিষ্কৃত হয়েছে তাও উত্তোলন করা সম্ভব হয়নি। তাই দেশের সকল সহায়-সম্পদের কার্যকর ব্যবহারে দক্ষ ব্যবস্থাপনার কোনো বিকল্প নেই ।
২. বৃহদায়তন উৎপাদন (Large-scale production) :
বৃহদায়তন উৎপাদন ব্যবস্থা যেকোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি । অথচ এর পরিচালনায় দক্ষ ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি । আমাদের দেশে চৌদ্দ কোটি মানুষের যে বড় বাজার রয়েছে এবং সস্তা শ্রম শক্তির কারণে দেশী-বিদেশী উদ্যোক্তাদের বড় ধরনের শিল্পে বিনিয়োগের যে চমৎকার সুযোগ এখানে বিদ্যমান; দেশীয় উদ্যোক্তাদের এবং সকল পর্যায়ের প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনার মানোন্নয়ন করেই তাকে কাজে লাগানো সম্ভব ।
৩. শিল্পোন্নয়ন (Industrial development) :
আমাদের দেশে বর্ধিত জনশক্তির কর্মসংস্থান ও দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হলে শিল্প খাতের উন্নয়নের কোনো বিকল্প নেই । অথচ শিল্প খাতের উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন সাহসী উদ্যোক্তা ও দক্ষ ব্যবস্থাপকের। প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যেও দেশের বস্ত্র শিল্প, পোশাক শিল্প, চামড়া শিল্প ইত্যাদি যেখানে যতটুকু উন্নতি লাভ করেছে এর পিছনে দক্ষ ব্যবস্থাপনার ভূমিকা উল্লেখযোগ্য ।

৪. দক্ষতা বৃদ্ধি (Increase of efficiency) :
বর্তমান তীব্র প্রতিযোগিতার বাজারে শ্রমশক্তি ও উপায়- উপকরণের দক্ষতা বৃদ্ধি ছাড়া সফলতা অর্জন সম্ভব নয়। সারাবিশ্বেই এরূপ দক্ষতার উন্নয়নে আধুনিক ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে । আমাদের দেশের শিল্প-বাণিজ্য তথা অর্থনৈতিক উন্নয়নে সীমিত সম্পদের বিশেষত মানব সম্পদের কার্যকর ব্যবহারের কোনোই বিকল্প নেই। জনশক্তির দক্ষতার উন্নয়ন ঘটিয়ে একে মানবশক্তিতে পরিণত করা সম্ভব হলে তার মাধ্যমেই আমাদের দেশের চোহারা পাল্টে যেতে পারে ।
৫. অপচয় হ্রাস (Reduction of wastage) :
বর্তমানকালে ব্যবস্থাপনার অন্যতম শ্লোগান হলো- “Minimising cost and maximising profit/production.” জাতীয় সম্পদের অপচয় কমিয়ে এর কার্যকর ব্যবহার করা গেলেই শুধুমাত্র দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিশ্চিত করা সম্ভব। আমাদের মতো দেশের সকল পর্যায়েই সহায়-সম্পদের ব্যাপক অপচয় লক্ষ্য করা যায়। তাই সস্তা জনশক্তি থাকার পরও এদেশে পণ্যের উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পায় । অথচ শুধুমাত্র দক্ষ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমেই অপচয় হ্রাস করা সম্ভব ।
৬. কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি (Creation of employment opportunity) :
বাংলাদেশ ব্যাপক জনঅধ্যুষিত একটি দেশ। বেকার সমস্যা এখানে প্রকট । অর্থনীতি তথা শিল্প-বাণিজ্যের উন্নয়ন ছাড়া বেকার সমস্যার সমাধান এখানে সম্ভব নয়। এশিয়ার মালয়েশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া ইত্যাদির মতো দেশ দক্ষ প্রশাসক, উদ্যোক্তা বা ব্যবস্থাপনার কারণে যেভাবে নতুন নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিতে সক্ষম হয়েছে সেদিকে তাকালে এ দেশেও শিল্প-বাণিজ্যের উন্নয়ন ঘটিয়ে বেকার সমস্যার সমাধান সম্ভব-তা বলা যায় ।
৭. সরকারি আয় ও রাজস্ব বৃদ্ধি (Increase of government income and revenues) :
সরকার অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী না হলে দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি সম্ভব নয় । এরূপ সমৃদ্ধি বিশেষভাবে নির্ভর করে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সামর্থ্য ও রাজস্ব আয় বৃদ্ধির ওপর । রপ্তানির পরিমাণ বাড়লে এবং দেশে শিল্প- বাণিজ্যের প্রসার ঘটলে সরকারের আয় ও রাজস্বের পরিমাণ বাড়ে । তাই আমাদের মতো দেশে সরকারের আয় ও রাজস্ব বৃদ্ধিতেও দক্ষ ব্যবস্থাপক শ্রেণীর উপস্থিতি ও কর্মপ্রয়াস অপরিহার্য ।
৮. সম্পর্কের উন্নয়ন (Improvement in relations) :
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিদেশী বিনিয়োগের প্রয়োজন অত্যধিক। এরূপ বিনিয়োগ নির্ভর করে একদিকে কার্যকর বিনিয়োগ পরিবেশ অন্যদিকে বিদেশী উদ্যোক্তাদের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপনের ওপর। বৈদেশিক ব্যবসায়ের ক্ষেত্রেও বিদেশী ব্যবসায়ীদের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ দক্ষ ও গতিশীল ব্যবস্থাপনার পক্ষেই এরূপ সম্পর্ক স্থাপন করে তা দেশের উন্নয়নে কাজে লাগানো সম্ভব ।
উপসংহারে বলা যায়, আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের গতি বাড়াতে হলে দক্ষ ব্যবস্থাপকদেরকেই অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে। মনে রাখতে হবে অর্থনীতি ও উৎপাদন বিমুখ রাজনীতি দিয়ে কখনই জাতির ভাগ্যের পরিবর্তন হবে না । সৎ ও যোগ্য প্রশাসন বা ব্যবস্থাপনাই শুধু অর্থনীতির চাকাকে এগিয়ে নিতে পারে । এ জন্য দক্ষ প্রশাসন প্রতিষ্ঠা ও ব্যবস্থাপনার উন্নয়নে সর্বোচ্চ নজর দেয়া আবশ্যক ।
আরও দেখুনঃ