ব্যবস্থাপনার সামাজিক দায়িত্ব পালনে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষ নিয়ে আজকের আলোচনা। এই পাঠটি “ব্যবস্থাপনা নীতিমালা” বিষয়ের ” ব্যবস্থাপনার পরিচিতি” বিষয়ক পাঠের অংশ। ব্যবস্থাপনা কীভাবে সামাজিক দায়িত্ব পালন করে বর্তমান বৃহদায়তন ব্যবসা-বাণিজ্যের জগতে ব্যবস্থাপনার কাজের আওতা যেমনি বৃদ্ধি পেয়েছে তেমনি সমাজের বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে ব্যবস্থাপনার সংশ্লিষ্টতাও বৃদ্ধি পেয়েছে।
Table of Contents
ব্যবস্থাপনার সামাজিক দায়িত্ব পালনে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষ
মাত্র দু’শ বছর আগেকার ব্যবসায়ীদের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরে অর্থনীতি শাস্ত্রের জনক অ্যাডাম স্মিথ (Smith) বলেছিলেন, “A great affair, we always find, is to get money.” অর্থাৎ আমাদের কাছে বড় কাজ হলো অর্থ উপার্জন । কিন্তু চোখ বুজে অর্থ উপার্জনের দিন গত হয়েছে। সর্বমহলে সচেতনতা বেড়েছে, পরিবেশ পরিস্থিতির ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে, দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন এসেছে আর বৃহদায়তন ব্যবসায় পরিচালনায় সমাজ সংশ্লিষ্টতা বেড়েছে ব্যাপকভাবে।
শীর্ষ ব্যবস্থাপনাকে আজকের দিনে ব্যাপক সময় ব্যয় করতে হচ্ছে সমাজ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে আলাপ- আলোচনা, মতবিনিময়, লেনদেন, চুক্তি সম্পাদন, যোগাযোগ রক্ষা ইত্যাদি কাজে। নিম্নে ব্যবস্থাপনা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষ বা ব্যবস্থাপনার সামাজিক দায়িত্ব পালনের আওতা রেখাচিত্রের সাহায্যে তুলে ধরা হলো :
উপরে বর্ণিত সমাজের বিভিন্ন পক্ষের প্রতি ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন বিষয়ে নিম্নে আলোচনা করা হলো :
১. মালিক বা শেয়ারহোল্ডারদের প্রতি দায়িত্ব (Responsibility toward shareholders or owners):
কোম্পানি সংগঠনে মালিকানা ও ব্যবস্থাপনা পৃথক বিবেচিত হওয়ায় শেয়ারহোল্ডারদের প্রতি ব্যবস্থাপনাকে দায়িত্ব পালন করতে হয় । যদিও শীর্ষ ব্যবস্থাপকগণ শেয়ারহোল্ডারদের প্রতিনিধিত্ব করে তথাপি সমাজের এ শ্রেণীর ব্যক্তিবর্গের সুবিধাপ্রাপ্তির বিষয়টি ব্যবস্থাপনার ওপর নির্ভর করে । এরূপ শ্রেণী ক্ষতিগ্রস্ত হলে বিনিয়োগ হ্রাস পায় এবং সামগ্রিকভাবে দেশের ব্যবসায় পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। তাই ব্যবস্থাপনা এ শ্রেণীর প্রতি নিম্নোক্তভাবে সামাজিক দায়িত্ব পালন করে থাকে :
ক) তাদের পুঁজি বা সম্পদের সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার;
খ) যতোটা সম্ভব তাদেরকে সর্বোচ্চ পরিমাণ লভ্যাংশ প্রদান;
গ) প্রতিষ্ঠানের মালিক হিসেবে তাদেরকে মর্যাদা দান এবং সে অনুযায়ী ন্যায়সঙ্গত আচরণ প্রদর্শন;
ঘ) প্রতিষ্ঠানের ও সেই সঙ্গে শেয়ারহোল্ডারদের সুনামের ক্ষতি হয় এমন কোনো কাজ থেকে বিরত থাকা ইত্যাদি ।
২. শ্রমিক-কর্মচারীদের প্রতি দায়িত্ব (Responsibility towards employees) :
প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরে নিয়োজিত শ্রমিক-কর্মচারী এ সমাজের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ। তাদের প্রতি নিম্নোক্ত দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে ব্যবস্থাপনা মূলত সমাজের প্রতি দায়িত্ব পালন করে থাকে :
ক) ন্যায্য মজুরি বা পারিশ্রমিক প্রদান;
খ) চাকরির স্থায়িত্ব ও ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা বিধান;
গ) প্রশিক্ষণ ও পদোন্নতির ব্যবস্থা;
ঘ) ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও প্রতিভার স্বীকৃতি;
ঙ) সন্তানদের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা;
চ) শ্রমিক-কর্মীদের কল্যাণমূলক বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ;
ছ) শ্রমিক-ব্যবস্থাপনা উত্তম সম্পর্ক বজায় রাখা ইত্যাদি ।
৩. ক্রেতা ও ভোক্তাদের প্রতি দায়িত্ব (Responsibility towards customers or consumers) :
ক্রেতা ও ভোগকারীগণ সমাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তাদের সহযোগিতা ও আস্থার ওপরই প্রতিষ্ঠানে সফলতা
নির্ভর করে । তাই তাদের প্রতিও ব্যবস্থাপনাকে দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট হতে হয়। ব্যবস্থাপনা তাদের জন্য নিম্নোক্তভাবে দায়িত্ব পালন করে:
ক) প্রয়োজনীয় সামগ্রী সহজে ও সহজশর্তে প্রাপ্তির সুযোগ সৃষ্টি;
খ) উন্নতমানের পণ্য ন্যায্যমূল্যে সরবরাহ;
গ) সর্বোচ্চ গ্রাহক সেবা নিশ্চিতকরণ;
ঘ) রুচি অনুযায়ী পণ্য উৎপাদন ও সরবরাহ নিশ্চিতকরণ; ঙ) স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক কোনো পণ্য উৎপাদন ও বিক্রয় না করা ইত্যাদি ।
৪. কাঁচামালের উৎপাদক ও সরবরাহকারীদের প্রতি দায়িত্ব (Responsibility towards producers of raw matarials and suppliers) :
পণ্য সরবরাহকারী ও কাঁচামালের উৎপাদকদের প্রতিও ব্যবস্থাপনা দায়িত্ব পালন করে থাকে; যা নিম্নরূপ :
ক) পণ্যের ন্যায্যমূল্য প্রদান;
খ) অর্থ প্রদানের নিশ্চয়তা বিধান;
গ) যথাসময়ে অর্থ প্রদান;
ঘ) প্রয়োজনে অগ্রিম অর্থ প্রদানের ব্যবস্থা ইত্যাদি ।

৫. পাওনাদারদের প্রতি দায়িত্ব (Responsibility towards creditors) :
আজকাল বৃহদায়তন ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান গঠনে ও পরিচালনায় ব্যবস্থাপকগণ সুবিধাজনক বিভিন্ন খাত থেকে ঋণ সংগ্রহের প্রয়াস চালায় । এরূপ ঋণ সরবরাহকারীদের প্রতিও ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব রয়েছে; যা নিম্নরূপ :
ক) ঋণ হিসেবে গৃহীত অর্থ সঠিক খাতে দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করা;
খ) ঋণকৃত অর্থ অন্যত্র সরিয়ে না ফেলা;
গ) ঋণের চুক্তি অনুযায়ী গৃহীত অর্থ যথাসময়ে ও যথানিয়মে ফেরৎ প্রদান করা;
ঘ) ঋণদাতাগণের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা ও সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলা ইত্যাদি ।
৬. সাধারণ সম্প্রদায়ের প্রতি দায়িত্ব (Responsibility towards general community) :
ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিভিন্ন পক্ষের প্রতিই শুধু দায়িত্ব পালন করে না; সমাজের সাধারণ সম্প্রদায়ের প্রতিও দায়িত্ব পালন করে । এরূপ দায়িত্ব পালনের মধ্যে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো আসে :
ক) শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সমাজকল্যাণধর্মী প্রতিষ্ঠান গঠন ও কাজে সহায়তা প্রদান;
খ) পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাস লাইনের ব্যবস্থা (প্রতিবেশীদের জন্য);
গ) রাস্তাঘাট নির্মাণ;
ঘ) জাতীয় দুর্যোগ বা জরুরি মুহূর্তে সহযোগিতা প্রদান;
ঙ) কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি ইত্যাদি ।
৭. প্রতিবেশী ব্যবসায়ীদের প্রতি দায়িত্ব (Responsibility towards local businessmen) :
বর্তমানকালে সুষ্ঠুভাবে ব্যবসায় পরিচালনার ক্ষেত্রে স্বগোত্রীয় ব্যবসায়ীদের প্রতিও ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালনের প্রয়োজন পড়ে। ব্যবসায়ীরা এরূপ দায়িত্ব পালন না করলে তাদের মধ্যে অন্যায় প্রতিযোগিতা ও রেষারেষি বৃদ্ধি পায় এবং এতে সকলেরই স্বার্থ বিপন্ন হয় । এ লক্ষ্যে ব্যবস্থাপনা যে সকল দায়িত্ব পালন করে তা নিম্নরূপ :
ক) প্রতিবেশী ব্যবসায়ীদেরকে সংঘবদ্ধ করা;
খ) পারস্পরিক সুসম্পর্ক গড়ে তোলার মাধ্যমে স্থানীয় ব্যবসায় পরিবেশের উন্নতি সাধন করা;
গ) একের অসুবিধায় অন্যের সহযোগিতা করা;
ঘ) অশুভ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত না হওয়া;
ঙ) প্রয়োজনীয় তথ্য বিনিময় করা; ইত্যাদি ।
৮. সরকারের প্রতি দায়িত্ব (Responsibility towards govt.) :
সরকার যেকোনো সমাজের সর্বোচ্চ প্রতিনিধিত্বশীল সংস্থা । তাই এ সংস্থার প্রতি দায়িত্ব পালনের মাধ্যমেও ব্যবস্থাপনা সমাজের প্রতি দায়িত্ব পালন করে । সরকারের প্রতি সম্পাদিত দায়িত্বসমূহ নিম্নরূপ :
ক) সরকারি নীতি ও পলিসি বাস্তবায়ন করা;
খ) ব্যবসায় ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থ সমুন্নত রাখা;
গ) সরকারের পাওনা কর ও রাজস্ব সঠিকভাবে প্রদান করা;
ঘ) স্থানীয় সরকারি প্রশাসনকে সর্বতো সহায়তা প্রদান করা;
ঙ) বেকার সমস্যা সমাধানে সহায়তা দেয়া;
চ) অবৈধ ব্যবসায়-বাণিজ্যে অংশগ্রহণ না করা;
ছ) প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে দেশের ভিতরে ও বাইরে সরকারের প্রতিনিধিত্ব করা;
জ) ব্যবসায় সংক্রান্ত বিষয়ে নীতি প্রণয়নে সরকারকে পরামর্শ প্রদান ও সহযোগিতা করা ইত্যাদি
৯. ব্যবসায়ী সংঘের প্রতি দায়িত্ব (Responsibility towards trade association) :
বর্তমানকালে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানগুলো নিজস্ব স্বার্থেই আঞ্চলিক ও জাতীয় বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংঘের সদস্য হিসেবে সম্পৃক্ত থাকে । এ সকল সংঘগুলো সঠিকভাবে চলার ওপর ব্যবসায়ের উন্নয়ন নির্ভর করে । তাই এক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনা নিম্নোক্তভাবে দায়িত্ব পালন করে :
ক) ব্যবসায়ী সংঘের সদস্য হিসেবে এর নিয়ম-নীতি অনুসরণ করা;
খ) সংঘের সদস্য হিসেবে এর সকল কাজে সক্রিয় অংশগ্রহণ করা;
গ) সংঘকে জোরদার করার স্বার্থে সঠিক সময়ে এর পাওনাদি পরিশোধ করা ইত্যাদি ।
১০. স্বার্থসংশ্লিষ্ট পক্ষসমূহের প্রতি দায়িত্ব (Responsiblity towards interest group) :
সমাজের বিভিন্ন স্বার্থ সংশ্লিষ্ট পক্ষসমূহের প্রতিও ব্যবস্থাপনা দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক অঙ্গনে নিজস্ব ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠার প্রয়াস চালায় । এক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনা নিম্নোক্তভাবে তার দায়িত্ব পালন করে :
ক) সামাজিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান; যেমন-ক্লাব, লাইব্রেরি, মিলনায়তন ইত্যাদি প্রতিষ্ঠায় ও পরিচালনায় সহায়তা করা;
খ) ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসমূহে সহায়তার মাধ্যমে সমাজে ভালো কাজকে উৎসাহিত করা;
গ) শিক্ষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রতিষ্ঠানসমূহকে পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া;
ঘ) রাজনৈতিক সংগঠনগুলোকে আর্থিক সহায়তা প্রদান করে সুষ্ঠু রাজনৈতিক চর্চায় উৎসাহিত করা
ইত্যাদি ৷ পরিশেষে বলা যায়, আধুনিক ব্যবস্থাপনা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সমাজের প্রতি নানাবিধ দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে সমাজের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক স্থাপনের প্রয়াস চালায়। যার কারণে পারস্পরিক আস্থা ও লেনদেনের মাধ্যমে সমাজ-সভ্যতার পাশাপাশি কারবার বা ব্যবস্থাপনাও সমতালে উন্নয়নের দিকে অগ্রসর হয়ে থাকে ।
আরও দেখুনঃ